সুষ্ঠুভাবে জাতীয় নির্বাচন পরিচালনার জন্য জুনেই একটি অন্তর্বর্র্তী সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের রূপরেখা দিতে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না। বলেছেন, সরকার এটি না করলে তাদের সরাতে গণআন্দোলন শুরু হবে। আর ওই আন্দোলনে সরকার খড়কুটোর মতো ভেসে যাবে। সরকার যদি সম্মানজনক পথ তৈরি না করে তাহলে তাদের পরিণতি ভয়াবহ হবে। গতকাল মানবজমিনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন।
সাক্ষাৎকারে বিরোধী জোটের চলমান আন্দোলন, চলমান রাজনীতি, অর্থনীতিসহ নানা বিষয়ে কথা বলেন।
সরকারের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, কীভাবে তারা অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করবে, কার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে সেটা তারাই বলুক। যদি না বলে তাহলে খুব স্বাভাবিকভাবেই গণআন্দোলনে এরা ভেসে যাবে। তাদের দল হিসেবে, সরকার হিসেবে এতদিনের অর্জন সবকিছু বিসর্জনে যাবে। পরিণতি আরও ভয়াবহ হবে। আমি সরকারকে সতর্ক করে অনুরোধ করতে চাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জুন মাসের মধ্যে এই ব্যবস্থা করুন।
সরকারকে বিরোধী জোটের পক্ষ থেকে এমন কোনো সময়সীমা বেঁধে দেয়া হচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নে গণতন্ত্র মঞ্চের এই নেতা বলেন, এক মাস পরে সরকার পড়ে যাবে এমনটা বলছি না।
আমি সরকারের শুভবুদ্ধির কাছে আপিল করছি। এগুলো তাদের দেখা উচিত। বিশেষ করে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক মিলিয়ে এমন অবস্থা হয়েছে যে, তার (শেখ হাসিনা) ক্ষমতায় থাকবার কোনো যৌক্তিকতা, কোনো পরিস্থিতি, পরিবেশ নাই। তাকে যেতে হবে। এখন এই যাওয়াটা তিনি কি সংঘাতের মধ্যদিয়ে যেতে চান, নাকি শান্তিপূর্ণভাবে যেতে চান তা তিনিই ঠিক করবেন। তিনি যদি শান্তিপূর্ণভাবে যেতে চান তাহলে তার রাজনীতি থাকবে, দল থাকবে। সংঘাতের মধ্যদিয়ে গেলে রাজনৈতিক পরিস্থিতিটা কি হবে তা বলা মুশকিল। এজন্য আমি তার (শেখ হাসিনা) কাছে আপিল করছি, তিনি যেন বা তার সরকার এই কাজটা (অন্তর্বর্তীকালীন সরকার) করেন।
সরকারের উদ্দেশ্যে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি বলেন, এখনো সময় আছে জুনের মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রূপরেখা তৈরি করে, গঠন করে, তার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করুন। আর তা না হলে বিকল্প আমরা তৈরি করে নিতে পারবো। অতীতেও তাই করেছি। অনুরোধ করি তার মানে এই নয় যে, দয়া ভিক্ষা করছি না। বলছি এটা শেখ হাসিনার করা উচিত। যদি না করেন তার পরিণতি তাকেই ভোগ করতে হবে।
মার্কিন ভিসা নীতির পর সরকার নমনীয় হয়েছে এমনটা মনে করছেন কিনা- এ প্রশ্নে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি বলেন, একটা ভিসা নীতি খুবই স্পষ্ট। যে আওয়ামী লীগের গত দুই টার্মের নির্বাচনে বাড়াবাড়ির কারণে, সামনের নির্বাচনকে সুষ্ঠু করতে, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করতে মার্কিনিরা ভিসা নীতি দিয়েছে। একটা ভালো নির্বাচনের জন্য এটা দিয়েছে। অথচ এটাকেও তারা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। যেন এটা বিরোধী দলের ওপর আসছে এমন ভাব দেখাচ্ছে আওয়ামী লীগ। বাস্তবে বিরোধী দল তো নির্বাচন বানচাল করে না। নির্বাচনে কারচুপি করে না। বিরোধী দল নির্বাচনে গায়ের জোরও করতে পারে না। এই কারণে তাদের মধ্যে যে ভীতির সঞ্চার হয়েছে, সেটাকে মোকাবিলা করার জন্য যে কৌশল করছে এটা আমরা বুঝতে পারছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাদের মধ্যে শুভবুদ্ধি জাগ্রত হচ্ছে না।
তিনি বলেন, সার্বিকভাবে দেশের পরিস্থিতি খুবই খারাপ। সরকার যতই করোনা আর ইউক্রেন যুদ্ধের দোহাই দিক না কেন, সত্যি কথা হচ্ছে আমাদের দেশে-বিদেশে ইনভেস্টমেন্টের খুবই খারাপ অবস্থা। আমাদের চাকরিতে নিয়োগদানের সুযোগ খুব কমে গেছে। কেবল মাত্র জিডিপি দিয়ে সবাইকে বুঝানোর চেষ্টা করছি। বাস্তবে মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার মান খুবই কমে গেছে। মানুষ ভেতরে ভেতরে কাঁদছে।
দেশে যেহেতু গণতন্ত্র নেই, নির্বাচন নেই, নির্বাচন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছে এই সরকার। এর ফল হচ্ছে এই, কান্না, গরিব মানুষের দুঃখ, কষ্ট। সরকার যে বুঝছে না, আমি তা বলবো না। কিন্তু সরকার এসবে কান দিচ্ছে না।
তিনি বলেন, পর পর দুটো জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ছলচাতুরি করে, গায়ের জোরে দখল করে নিয়ে ক্ষমতায় থাকার কারণে তারা মনে করেছে. এইভাবেই বুঝি চলা যায়। মানুষের সহ্য করার তো একটা সীমা আছে। রাজনৈতিক কর্মীদের নামে কতো অজস্র মামলা। এবং তাদের কারও কারও সাজা দেয়াও শুরু হয়ে গেছে। অনেকে ঘরে থাকতে পারে না। এমন অনেক বিরোধী দলের নেতাকর্মী দেখেছি যারা ১০ বছর পর্যন্ত বাড়ি যেতে পারেনি। ঘুমাতে পারেনি। তাদের বিরুদ্ধে যে মামলা আছে তা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। নির্বাচন যদি নিরপেক্ষ হতো তাহলে এসব মামলা হতো না।
মান্না বলেন, সরকার বিচার ব্যবস্থাকেও এমনভাবে কুক্ষিগত করে রেখেছে। যেটা ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র স্বীকারই করলেন। তারা সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি পর্যন্ত বদলে দিয়েছেন। এর মানে তারা সংবিধানের বাহিরে গিয়ে গায়ের জোরে বিচারপতি বদলে দেয়, কোর্ট বদলে যায়, রায় বদলে যায়। জনগণের অধিকার মানে না। ভোটের ব্যাপারে মানুষের কোনো নিরাপত্তা নেই। মানুষ ভোট দিতে পারে না। ভোট দেয় একজনকে, রেজাল্ট যায় আরেক দিকে। এসব কিছু মিলে একটা বিভীষিকাময় পরিস্থিতি তৈরি হয়ে আছে।
চলমান সংকট উত্তরণের উপায় জানতে চাইলে মান্না বলেন, একটাই সমাধান। দেশে একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করতে হবে। সেই কথা আমরা বহুদিন ধরে বলে আসছি। এবং বলেছি একটা যথাযথ নির্বাচনের মাধ্যমে যে সরকার আসবে সেই সরকারই কেবলমাত্র গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করতে পারে। কিন্তু সরকার সেই রকম নির্বাচন দিচ্ছে না। ইতিমধ্যে আন্দোলন দমন করার জন্য তারা গুম, খুন, অপহরণের মতো বহু ঘটনা ঘটেছে। আয়না ঘর নিয়ে ডয়েচে ভ্যালে যেসব চিত্র দেখিয়েছে তার মধ্যদিয়ে প্রমাণ হয়েছে। সবকিছু মিলে পরিস্থিতি এমন একটা পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে, এই সরকারকে রেখে একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য যথাযথ নির্বাচন হচ্ছে না। কারণ গত ১৫ বছরে সরকার নির্বাচন ব্যবস্থাকে পালাক্রমে ধ্বংস করেছে। সবাই মিলে যখন কথা বলেছে তখন তারা কোনো কথা কানে তোলেনি। কোনো কোনো সময় যদি জনগণের আওয়াজ একটু বড় হয়েছে, তখন ষড়যন্ত্র, ছলনা, প্রতারণা করে নির্বাচনকে নিজেরা গিলে খাওয়ার চেষ্টা করেছে।
তিনি বলেন, কথায় আছে চোরের ১০০ দিন আর গেরস্থের ১ দিন। এখন জনগণের দিন এসে গেছে। মানুষ এক হয়েছে। মানুষ মনে করছে যে এই সরকারের পতন করতে হবে। এজন্য রাজপথে নেমেছে। বিশাল বিশাল সমাবেশ হচ্ছে। তাদের কথা একটাই যে, এই সরকারের অধীনে আর নয়। বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন নয়। যেহেতু নির্বাচন সামনে সেহেতু সরকার পদত্যাগ করবে। এবং একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হাতে ক্ষমতা দিবে। সেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশে যাতে সত্যিকার একটা ভোটের ব্যবস্থা করা যায়, সবার জন্য মাঠ সমান করা যায় এবং মানুষের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করা যায় সেই ব্যবস্থা করবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি এটি নিয়ে যথেষ্ট কথা হয়েছে। সরকার গায়ের জোরে, গুলি করে মানুষ হত্যা করে এগুলো দমন করার চেষ্টা করেছে। এখনো করছে।
মান্না বলেন, ইতিমধ্যে সরকার বিরোধী আন্দোলন জাতীয় গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও পৌঁছে গেছে। যে অত্যাচার নির্যাতনগুলো করা হয়েছে, সে সমস্ত অত্যাচারিত, নির্যাতিত মানুষ আন্তর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন বড় বড় শক্তির কাছে তাদের দুঃখ দুর্দশার কথা বলেছে। ফলে র্যাবের ওপরে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। সেই নিষেধাজ্ঞার কারণে আমরা দেখেছি র্যাব কিছুটা চুপচাপ হয়েছে। সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নীতি প্রয়োগ করেছে। যদিও সরকার সেটিকে বিভ্রান্তের জালের মধ্যে আটকাতে চেয়েছে যে, সেটা আমাদের (আওয়ামী লীগ) জন্য নয়, এটা বিরোধীদলের জন্য।
যুক্তরাষ্ট্র কেন এই ভিসা নীতি দিয়েছে বলে মনে করেন- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, দেশে সবকিছু ঠিকঠাক চলতো তাহলে তো ভিসা নীতি আসতো না। ৪/৫টা যেসব দেশে ভিসা নীতি দেয়া হয়েছে, সেসব দেশে ভোটে জালিয়াতি হয়েছে। যেসব দেশে ভোটে জালিয়াতি হয়নি, সেখানে আমেরিকা ভিসা নীতি দেয়নি। বাংলাদেশে ভিসা নীতি দেয়ার কারণ ভোটে জালিয়াতি হয়েছে, বল প্রয়োগ করা হয়েছে, ভোটকেন্দ্র দখল করে নেয়া হয়েছে। এটা তারা (আওয়ামী লীগ) স্বীকার করতে চায় না। তারা প্রতিশ্রুত দিয়েছে ভোট ঠিকমতো করবে, অঙ্গীকার রক্ষা করবে। কিন্তু সেই অঙ্গীকারের কোনো দাম নেই। কারণ অতীতেও এমন অঙ্গীকার করে সরাসরি বরখেলাপ করেছে।
২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে তারা (আওয়ামী লীগ) বলেছিলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আমাদের যে সমস্ত দাবি আছে তারমধ্যে বিশেষ করে হাজার নেতাকর্মীদের নামে গায়েবি মামলা তুলে দেয়া হবে। শেখ হাসিনা নিজের মুখে বলেছিলেন যে এটা করবেন। অথচ তিনি তা করেননি। তখন তিনি বলেছিলেন ‘আমি বঙ্গবন্ধু’র মেয়ে, আমি আমার পিতার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আপনাদের কাছে অঙ্গীকার করছি এসব করবো। অথচ তিনি তা করেননি।’ তার (শেখ হাসিনা) কথা বিশ্বাস করার মতো এখন আর কেউ নেই। তিনি যে এটা আমাদের সঙ্গে করেছেন তা নয়, আন্তর্জাতিক মহলেও করেছেন। এখন আন্তর্জাতিক মহল যে চাপ দিচ্ছে তাতে আমরা ভয় পাচ্ছি। পুরো দেশ অন্ধকারের ভেতর তলিয়ে যেতে পারে।