এটা কোনো নজিরবিহীন দৃশ্যপট নয়। ভোটের আগে এমন হয়েই থাকে। যদিও নির্বাচনের পথচিত্রটি এখনো পরিষ্কার নয়। তবে জুন মাসে এসে রাজনীতিতে তিনটি দল নিয়ে কৌতূহল তৈরি হয়েছে। শোনা যাচ্ছে, আলোচনা-গুঞ্জন। জাতীয় পার্টিতে দেবর-ভাবী দ্বন্দ্ব আবার প্রকাশ্যে এসেছে। ঢাকা-১৭ আসনে লাঙ্গল নিয়ে চলছে টানাটানি। তবে এটি দলটি নিয়ে কৌতূহল তৈরি হওয়ার কারণ নয়। প্রশ্ন হচ্ছে আগামী দিনের রাজনীতিতে জাতীয় পার্টির ভূমিকা কী হবে? রওশন এরশাদের অবস্থান পরিষ্কার। দলের ওপর তার প্রভাব অবশ্য সামান্য।
কথা হচ্ছে জিএম কাদের কী করবেন? চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন এতদিন একধরনের সমঝোতার লাইনেই চলেছে। কিন্তু বরিশাল সিটি নির্বাচনের পর দৃশ্যপট অনেকটা বদলে গেছে। এরইমধ্যে ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভ করেছে দলটি। সিলেট ও রাজশাহীর নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে। এক দশক পর ঢাকায় সমাবেশ করেছে জামায়াত। আপাত জোটছুট দলটির অবস্থান নিয়েও চলছে নানা আলোচনা। জামায়াতের সূত্র বলছে, সতর্কতার সঙ্গেই পা ফেলবে তারা। দলটির নীতির ক্ষেত্রেও বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
তবে রাজনীতিতে এখন সবচেয়ে বড় কৌতূহল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরকে নিয়ে। এ মাসের শুরুতে তিনি বৈঠক করেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে। ওই বৈঠক শেষে তার বিশেষ দূত মাশরুর মওলার বক্তব্য রাজনীতিতে চাঞ্চল্য তৈরি করে। তিনি মিডিয়াকে বলেন, বৈঠকে জাপা’র নির্বাচন পরিকল্পনা, আগামী নির্বাচনে জোট করবে কিনা তা জানতে চেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে এরপর পশ্চিমা নয়, এমন একটি দেশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে জিএম কাদেরের একাধিক বৈঠক হয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্র দাবি করছে। সর্বশেষ বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় গত শুক্রবার। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে এরইমধ্যে আন্তর্জাতিক মেরূকরণ স্পষ্ট হয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং তার পশ্চিমা মিত্ররা সরকারের ওপর একধরনের চাপ তৈরি করেছে। চীনের পক্ষ থেকে সরকারের প্রতি সমর্থন ঘোষণা করা হয়েছে প্রকাশ্যেই। ভারতের অবস্থানও মোটামুটি স্পষ্ট।
সম্প্রতি নয়াদিল্লিতে যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার বৈঠকে ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে দাবি ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের। ইকোনমিক টাইমস খবর দিয়েছে, এমন দুটি প্রতিবেশী বাংলাদেশ এবং মালদ্বীপের জাতীয় নির্বাচন যথাক্রমে আগামী বছরের শুরুতে এবং এ বছরের শেষের দিকে। এক্ষেত্রে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি হলো-‘তার প্রতিবেশীদের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এমন কোনো পদক্ষেপ নেয়া উচিত হবে না, যা ভারতের জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়।’ ইকোনমিক টাইমসের এ রিপোর্ট আমরা যাচাই করতে পারিনি। আন্তর্জাতিক মেরূকরণের সঙ্গে জাতীয় পার্টি বা জিএম কাদেরের রাজনীতির অবস্থানের যোগসূত্র থাকতে পারে বলে ঢাকার রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকের ধারণা। চলমান রাজনীতি নিয়ে অবস্থান জানার জন্য বারবার চেষ্টা করেও জিএম কাদেরের বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। তবে সম্প্রতি তার দুটি বক্তব্য রাজনীতিতে আলোচিত। একটিতে তিনি উল্লেখ করেছেন, সরকার ভিন্ন নামে জামায়াত এবং জাতীয় পার্টিকে কিছু আসন দিতে চায়। আরেক বক্তব্যে তিনি দলে সরকারের অনুগতদের দিকে ইঙ্গিত করে তাদের সতর্ক করেছেন। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জিএম কাদেরের অবস্থান বুঝতে আরও সময় লাগবে।
জামায়াতকে নিয়েও রাজনীতিতে একধরনের কৌতূহল তৈরি হয়েছে। এক দশক পর পুলিশের অনুমতি নিয়ে ঢাকায় সমাবেশ করেছে আলোচিত-সমালোচিত দলটি। সরকারের সঙ্গে সমঝোতার গুঞ্জনও তৈরি হয়েছে। যেটা সরকারের মন্ত্রীরা আগেই নাকচ করেছেন। বর্তমান জামায়াতের দু’জন প্রভাবশালী নেতাও সমঝোতার গুঞ্জন অস্বীকার করেছেন। তবে তারা এটাও বলেছেন, অতীতে তারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে কাজ করেছেন। জামায়াতের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এবার তারা কোনো ধরনের হার্ডলাইনে যাবে না। নিজেদের সীমিত সামর্থ্য দিয়ে যতোটা সম্ভব কর্মসূচি পালন করবে। কোনো জোটেও সরাসরি অন্তর্ভুক্ত হবে না। মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নেও পুরনো অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসার ইঙ্গিত দিচ্ছে দলটি। ডয়চে ভেলের টকশোতে জামায়াতের নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ১৯৭১ সালে জামায়াতের বক্তব্য অনুচিত এবং এ ধরনের বক্তব্যের বৈধতা দেয়ার সুযোগ নেই।’ জামায়াতের সূত্রগুলো বলছে, তারা এবার ফ্রন্টলাইনে ভূমিকা রাখবে না। এ ধরনের সামর্থ্যও তাদের নেই। কখনো কখনো তাদের সামর্থ্যকে বড় করেও দেখানো হয়। তবে জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য শফিকুল ইসলাম মাসুদ মানবজমিনকে বলেন, জামায়াত সবসময়ই আলোচনায় থাকে। দলটি আন্দোলনে সক্রিয় থাকবে বলেও জানান তিনি।
জাতীয় পার্টি-জামায়াতের মতো আলোচনায় আছে ইসলামী আন্দোলনও। বরিশাল সিটি নির্বাচনে প্রার্থী এবং নায়েবে আমীর মুফতি ফয়জুল করীমের ওপর হামলা দলটিকে ক্ষুব্ধ করেছে। তাৎক্ষণিকভাবেই ইসলামী আন্দোলন সিলেট এবং রাজশাহীর নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে। দলটি এরইমধ্যে সারা দেশে বিক্ষোভ করেছে। সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের কঠোর সমালোচনা করেছেন চরমোনাই পীর। ইসলামী আন্দোলন এখন সরকারবিরোধী আন্দোলনে কোনো অবস্থান নেয় কি-না সেদিকে খেয়াল রাখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
ভিসা নীতি। চিঠির পর চিঠি। দৌড়ঝাঁপ। গোপন কূটনীতি। রাজপথে সমাবেশ-পাল্টা সমাবেশ। ইঙ্গিত মেলে নির্বাচন পর্যন্ত রাজনীতি হবে চরম উত্তেজনাপূর্ণ এক ম্যাচ। অনেকটা ফ্রান্স-আর্জেন্টিনা ফাইনালের মতো। আপাত রাজনীতিতে কৌতূহল তৈরি করা তিন দলের গন্তব্য কোথায় সেদিকেই দৃষ্টি সবার। যদিও তারা প্রধান খেলোয়াড় নয়।