বিশ্ব মোড়লদের স্পটলাইটে বাংলাদেশ

জাতীয় নির্বাচনের আর কয়েক মাস বাকি। দেশ-বিদেশে আলোচনা একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা বিশ্বের প্রবল চাপ। র‌্যাবের সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নয়া ভিসা নীতি ঘোষণা। এর প্রতিক্রিয়ায় সরকারের কড়া জবাব। সরকারের অবস্থানে চীনের সমর্থন। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ এখন পুরো বিশ্বের নজরে। স্পটলাইটে। চলছে নানা হিসাবনিকাশ। আঞ্চলিক, আন্তর্জাতিক নানা ভূ-সমীকরণ।

কী হচ্ছে? কী হবে? এমন নানা প্রশ্ন সব মহলে। পরিস্থিতি নিয়ে মানবজমিনের সঙ্গে কথা বলেছেন রাজনীতিবিদ, বিশিষ্টজন ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। জানিয়েছেন তাদের নিজস্ব মতামত। তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন আলতাফ হোসাইন ও শরিফ রুবেল:
তানজীম উদ্দীন খান, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন যে মেরূকরণের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, সেখানে চীন একটা মেরুর কেন্দ্রবিন্দুতে। এখন রাষ্ট্র হিসেবে চীনের যে বৈশিষ্ট্য, তাদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা কিন্তু নেই। কমিউনিস্ট পার্টির শাসন এবং তাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আছে। মূলত পশ্চিমা দেশগুলোর নেতৃত্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সেক্ষেত্রে চীনের রাষ্ট্রগত বৈশিষ্ট্যের দুর্বলতা, অর্থাৎ পার্টি শাসিত রাষ্ট্র কিংবা অন্য অর্থে স্বৈরশাসন; ঠিক একইভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অনেক ঘটনা আছে। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী জনসমর্থন আদায়ের জন্য তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে মানবাধিকার ইস্যুটাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবে। সেটার প্রকাশ আমরা দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে দেখছি। বিশেষ করে ইন্দোপ্যাসিফিক অঞ্চলের নিকটবর্তী হওয়ার কারণে এই পরাশক্তিগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বাংলাদেশ একটা ক্ষেত্র বা মঞ্চে পরিণত হয়েছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ করে অর্থনৈতিক শক্তি যেহেতু আগের অবস্থায় নেই। আর চীন বিশ্বে প্রভাব বিস্তার করছে। চীনের এই প্রভাব বিস্তারকে ঘিরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র খুবই স্পর্শকাতর। সেজন্যই চীনের এই দুর্বল বৈশিষ্ট্যকে ঘিরে তারা তাদের পররাষ্ট্রনীতিটা বাস্তবায়ন করতে চাইছে। যেটার প্রকাশ বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও ঘটছে।

বাংলাদেশের সামনের নির্বাচন অবাধ হওয়ার ক্ষেত্রে একটা চাপ নিশ্চয়ই তৈরি হচ্ছে। যার উদাহরণ আমরা গাজীপুর সিটি নির্বাচনে দেখলাম। যদিও সরকারি দলেরই আরেকটি অংশকে আমরা নির্বাচিত হতে দেখেছি। এটিকে সরকার দেখাতে চেয়েছে অবাধ নির্বাচনের সফলতা হিসেবে। কিন্তু নির্বাচন তো আসলে এভাবে সাফল্য দেখানোর বিষয় না। অবাধ নির্বাচনটা নির্ভর করবে আমাদের যে রাজনৈতিক দলগুলো আছে তাদের মধ্যে যে আস্থার সংকট, সেই সংকট কাটাতে পারলাম কিনা। আর আস্থার সংকট কাটাতে না পারলে, বিশেষ করে সরকারি দল ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় যে নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে, ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতায় রেখে সেই জায়গাটাতে ফিরে আসা সম্ভব না।

বিশেষ করে ’৯১ সাল থেকে ২০০৮ পর্যন্ত অনাস্থার কারণেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসেছিল। কিন্তু সংবিধান থেকে সেটি বাদ দিয়ে পরবর্তীতে আস্থার পরিবেশ তৈরির পরিবর্তে অনাস্থার জায়গাটা আরও শক্তিশালী করেছে। অনাস্থাটা চরমে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই অনাস্থার পরিবেশ টিকিয়ে রেখে অবাধ নির্বাচন সম্ভব কিনা সেটি নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।

এখন চীনের সমর্থনের মধ্যদিয়ে এটা খুব স্পষ্ট হয়ে গেল যে, চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বলয়ের যে প্রতিযোগিতা, সেই প্রতিযোগিতার মাঝখানে আমরা চাপে পড়েছি। এটার মধ্যদিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও কিন্তু আরেকটি প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে। ফলে এই সংকট কাটার চাইতে বরং সংকট আরও ঘনীভূত হওয়ার ক্ষেত্রে এই ধরনের সমর্থন সহায়ক হয়ে উঠছে।

এখন সরকারের করণীয় হলো- তারা জনগণের স্বার্থ বিবেচনা করছে কিনা। জনগণের স্বার্থ যদি বিবেচনা করে এবং সেই আত্মবিশ্বাস থাকে তাহলে এই পরীক্ষা দিতে তো আমি কোনো সমস্যা দেখি না। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সেই আস্থার জায়গাটা তৈরি করা, প্রতিষ্ঠানগত এক ধরনের আয়োজন থাকা, যার মধ্যদিয়ে অবাধ নির্বাচনটা নিশ্চিত হবে। বর্তমান যারা ক্ষমতায় আছে তারা ক্ষমতায় থেকে এটা তো আসলে সম্ভব না। এটার ওপর কেউ আস্থাও রাখতে পারে না। ফলে এটা এখন নির্ভর করছে ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক কেন্দ্রবিন্দুতে বাংলাদেশের স্বার্থ বাংলাদেশের মানুষ আছে কিনা। আর যদি মনে করি যে, না আমার দলের স্বার্থটাই গুরুত্বপূর্ণ, তাদেরকে রক্ষা করাটাই গুরুত্বপূর্ণ; সেই ক্ষেত্রে মনে তো হয় না যে, এই সংকট আর এই পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন আসবে। রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রবিন্দুতে যদি দেশের কল্যাণ আর জনগণের স্বার্থ থাকে, তাহলে সেই দলের জনপ্রিয়তা তো আরও বাড়বে, কমবে না।

এম শাহীদুজ্জামান, সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক এম শাহীদুজ্জামান বলেন, পশ্চিমা শক্তি, চীন ও রাশিয়া যা করছে। তা কখনোই হতো না। যদি দেশে একটি নির্বাচিত সরকার থাকতো। তাহলে এমন ঘটনা ঘটতো না। বাংলাদেশে একটা সরকার আছে যারা অবাধ ভোটে নির্বাচিত নয়। এজন্য বাইরের বড় বড় দেশগুলো বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলার সুযোগ পাচ্ছে। বিনা নির্বাচনে ক্ষমতা দখল করে রাখলে এসব বহির্বিশ্ব কতোদিন সহ্য করবে। এমন অবস্থা থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করতে ভিসা নীতি ঘোষণা খুবই প্রয়োজন ছিল। আশা করি, এ নীতি বাংলাদেশের মানুষের জন্য সুফল বয়ে আনবে।

শ. ম. রেজাউল করিম, মন্ত্রী, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়
বাংলাদেশের যেকোনো সংকটের মুহূর্তে অনেক দেশ পাশে থেকেছে। বর্তমানেও অনেক দেশ বাংলাদেশের পাশে আছে। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সাংবিধানিকভাবেই টিকে থাকবে। এখানে কোনো বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপ কিংবা ষড়যন্ত্র মেনে নেয়া হবে না। একটি দেশের পক্ষে যেকোনো দেশই সমর্থন জানাতে পারে।

আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, স্থায়ী কমিটির সদস্য, বিএনপি
নির্বাচন নিয়ে কয়েকটি বড় দেশ যে লড়াই শুরু করেছে। এতে কারও জয় হবে না। এই লড়াইয়ে বাংলাদেশের মানুষের জয় হবে। গণতন্ত্রের জয় হবে। ভোটাধিকার ফিরে আসবে। আইনের শাসন ফিরে আসবে। মানবাধিকার ফিরে আসবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার জয় হবে। এর বাইরে কারও জয় হওয়ার কিছু নেই। একটা বিষয় পরিষ্কার, বাংলাদেশের পক্ষে যারা থাকবে আমরা তাদের পক্ষে থাকবো। বাংলাদেশের স্বার্থ, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও মানুষের অধিকারের পক্ষে যারা থাকবে তারাই বাংলাদেশের প্রকৃত বন্ধু। আর যারা এসবের পক্ষে থাকবে না। তারা কখনো বাংলাদেশের বন্ধু হতে পারে না। দেশের মানুষের বিপক্ষে অবস্থান নিলে সে কীভাবে বন্ধু হয়? গণতন্ত্র, আইনের শাসন, ভোটাধিকার, মানবাধিকার, জীবনের নিরাপত্তা এগুলো কখনো অভ্যন্তরীণ বিষয় না। যারা এগুলোকে অভ্যন্তরীণ বিষয় বলেন আসলে তাদের বিরুদ্ধে যায় বলে তারা এসব বলে পার পেতে চান। আমরা তো এগুলোর বিষয়ে জাতিসংঘ সনদের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এগুলো বিশ্ব মানবতার বিষয়। তাই এসব যেখানে লঙ্ঘিত হবে বিশ্ব বিবেক সেখানেই জাগ্রত হবে। এটাই স্বাভাবিক বিষয়।

হাসানুল হক ইনু, সভাপতি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল
বাংলাদেশ নিয়ে পশ্চিমা, চীন ও রাশিয়া দ্বন্দ্বে বহিঃশক্তির কেউই জয়ী হবে না। এতে জয়ী হবে সরকার। কারণ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ের ফয়সালা এদেশের সরকারই করবে। দেশের জনগণই করবে। এক্ষেত্রে বাইরের দেশের নাক গলানোর অধিকার নেই। আমাদের দেশের বিষয়ে তারা হস্তক্ষেপ করার কে? তাদের সেই এখতিয়ার ও যোগ্যতা নেই। চীনা দূতাবাসের বিবৃতি পরিষ্কার। তারা বলেছে, বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করছে। এটা তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। চীন এর বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছে। আর মার্কিন ভিসা নীতির সঙ্গে গণতন্ত্র ও নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই।

মাহমুদুর রহমান মান্না, সভাপতি নাগরিক ঐক্য
ভিসা নীতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে সামঞ্জস্য নেই। তিনি রাগ করে বললেন আমেরিকা যাবেন না। তাহলে নিজের লোকদের বলুক সবাই চলে আসো। এটা তো কখনো বলবেন না। প্রধানমন্ত্রী যদি বলতেন, যে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে আমেরিকার কথা বলা ঠিক হচ্ছে না। বরং এই কথাটা কিছুটা হলেও যুক্তিযুক্ত ছিল। আমেরিকা ভিসা না দিলে চীনের কী করার আছে? চীন বিবৃতিতে শেখ হাসিনাকে বোঝাতে চাচ্ছে- তুমি যা খুশি করো, আমরা তোমার পাশে আছি। এই সরকার দেশের জনগণ ও গণতন্ত্রের জন্য কিছু করছে না। তারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করছেন। সুতরাং তারপরেও যদি চীন তাদের সমর্থন দেয়, সেটা মোটেও গ্রহণযোগ্য হবে না। ভিসা নীতির পরে প্রশাসনে বেশকিছু সংযত ভাব এসেছে। এই সরকার ক্ষমতায় থাকলে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কোনোভাবেই হবে না।

মুজিবুল হক চুন্নু, মহাসচিব, জাতীয় পার্টি
জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, আসলে আমাদের দেশের বড় দুটি দলের নেতিবাচক কার্যকলাপের জন্য বাইরের দেশ কথা বলার সুযোগ পাচ্ছে। আমরা চীন, রাশিয়া ও আমেরিকা বুঝি না। আমরা একটা জিনিস বুঝি। সেটা হচ্ছে দেশের জনগণ কী চায়। এখন জনগণের দাবি হচ্ছে, একটা অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। সেই নির্বাচন করার জন্য সবার ভূমিকা থাকা উচিত। সবচেয়ে বড় ভূমিকা হলো সরকারের। আমরা চাই সরকার সব দলকে নিয়ে একসঙ্গে বসে আলোচনার মাধ্যমে একটি পরিবেশ সৃষ্টি করুক। এখন বাইরের দেশ কে কি বললো এটা তাদের নিজস্ব বিষয়। এটা আমাদের ভাবনার কোনো বিষয় না। আমাদের দেশের যেকোনো সমস্যা ঠিক করবে জনগণ। এখানে অন্য কারও দরকার নেই। তবে দেশের নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র একটি ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে। আমরা এটাকে সমর্থন জানাই। এর বাইরে কিছু বলতে চাই না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *