১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে স্বাক্ষরিত সাত দফা চুক্তি বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত ও রহস্যঘেরা অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়। এই চুক্তিকে অনেকেই ‘গোলামির চুক্তি’ বা ‘ঐতিহাসিক ভুল’ বলে আখ্যায়িত করেন। চুক্তিটি এতটাই গোপনীয় ছিল যে, মুজিবনগর সরকারের অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাও এ সম্পর্কে জানতেন না বলে দাবি করেন ইতিহাসবিদরা।
মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ ও ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারতের সাথে এই চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন। কথিত আছে, চুক্তি স্বাক্ষরের পর সৈয়দ নজরুল ইসলাম জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন, যা চুক্তির কঠোর শর্তাবলির ভয়াবহতাকে ইঙ্গিত করে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর চাপেই এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল।
চুক্তির প্রথম শর্তে বলা হয়েছিল শুধুমাত্র সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধাদেরই প্রশাসনিক পদে বহাল রাখা হবে, অন্যদের অপসারণ করে সেখানে ভারতীয় কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হবে। দ্বিতীয় শর্তে বাংলাদেশের নিজস্ব কোনো সেনাবাহিনী রাখার অনুমতি দেওয়া হয়নি। তৃতীয় শর্তে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য মুক্তিবাহিনীকে প্যারামিলিশিয়া বাহিনীতে রূপান্তরের কথা বলা হয়। চতুর্থ শর্তে দুই দেশের মধ্যে খোলা বাজার অর্থনীতি চালু এবং ব্রিটিশ পাউন্ডে লেনদেনের বিধান রাখা হয়।
চুক্তির পঞ্চম শর্তে স্বাধীনতার পর অনির্দিষ্টকালের জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীকে বাংলাদেশে অবস্থানের অনুমতি দেওয়া হয়। ষষ্ঠ শর্তে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত লড়াইয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কমান্ডে যুদ্ধ পরিচালনা এবং আত্মসমর্পণ দলিলে বাংলাদেশের স্বাক্ষর না রাখার বিধান করা হয়। সবচেয়ে বিতর্কিত সপ্তম শর্তে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে সমন্বয় করে চলার শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়।
মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী তার ‘হক কথা’ পত্রিকায় এই চুক্তিকে ‘ভারতের প্রতারণা’ বলে কঠোর ভাষায় নিন্দা জানিয়েছিলেন। নুরুল কাদেরের ‘২৬৬ দিনের স্বাধীনতা’ গ্রন্থের ৩২৫ পৃষ্ঠায় এই চুক্তির বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। অনেক বিশ্লেষকের মতে, এই চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার নামে আসলে ভারতের করতলগত করাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। এই চুক্তি কখনোই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়নি, যা এর গোপনীয়তাকে আরো রহস্যময় করে তোলে। বর্তমান প্রজন্মের জন্য এই চুক্তি বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী রাজনৈতিক ইতিহাস বোঝার একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। এটি আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ কী এবং কীভাবে একটি জাতিকে তার সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সদা সচেষ্ট থাকতে হয়।