চট্টগ্রামে ইসলামী ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখায় এস আলম গ্রুপের ১২টি কোম্পানির ফান্ডেড ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ২২ হাজার কোটি টাকার বেশি, যদিও আইন অনুযায়ী ব্যাংকটির দেশের সব শাখা মিলিয়ে একটি কোম্পানিকে ঋণ দেওয়ার সর্বোচ্চ সীমা দেড় হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি।
এর বাইরে নন ফান্ডেড ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৪৫ হাজার কোটি টাকা, যদিও ঋণসীমা অনুযায়ী তারা সর্বোচ্চ ১ হাজার ৪২ কোটি টাকা ঋণ দিতে পারত।
খাতুনগঞ্জ ছাড়াও দেশের অন্যান্য জায়গায় ইসলামী ব্যাংকের শাখায় আরও কয়েক হাজার কোটি টাকার ঋণ রয়েছে এস আলম গ্রুপের।
২০১৭ সালে পুঁজিবাজার থেকে শেয়ার কিনে এবং ‘জোরজবরদস্তি করে’ ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার অভিযোগের মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এই বিপুল অঙ্কের ঋণের তথ্য সামনে এল।
কীভাবে একটি শাখা তার নির্ধারিত সীমার বাইরে কয়েকশ গুণ বেশি ঋণ দিল, সেই প্রশ্নের জবাব পাওয়ার সুযোগও দিচ্ছেন না ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা। গত ৫ অগাস্ট সরকার পতনের পর থেকে তিনি কার্যালয়ে আসছেন না, ফোন করলেও সাড়া দিচ্ছেন না। এসএমএস দিলেও তার সাড়া মেলেনি।
ব্যাংকটির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলতাফ হোসেন, জে কিউ এম হাবিবুল্লাহ এফসিএস, উপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) মিফতাহ উদ্দিন, মোহাম্মদ আকিজ উদ্দিন, কাজী রেজাউল করিম, কামাল হোসেন, মোহাম্মদ সাব্বির অফিস করছেন না, ফোনেও পাওয়া যাচ্ছে না তাদেরকে।
সরকার পতনের পর ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে যে আন্দোলন শুরু হয়েছে, তাতে চাপের মুখে পড়ে পদত্যাগ করেছেন অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ কায়সার আলী।
ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণমূলক মূলধন ১০ হাজার ৪১৪ কোটি টাকা। তাতে নিয়ম মোতাবেক এস আলম গ্রুপ ইসলামী ব্যাংক থেকে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৫৬২ কোটি টাকা ফান্ডেড ঋণ নিতে পারবে। কারণ ব্যাংকের মূলধনের সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ পর্যন্ত ফান্ডেড ঋণ নেওয়া যায়।
একক গ্রুপ হিসেবে ননফান্ডেড ঋণ নেওয়ার সীমা ছিল আরও ১ হাজার ৪২ কোটি টাকা, যা ব্যাংকটির মূলধনের ১০ শতাংশ।
ফান্ডেড ও নন ফান্ডেড মিলিয়ে গ্রুপটি ইসলামী ব্যাংক থেকে মোট ঋণ পেতে পারত সর্বোচ্চ ২ হাজার ৬০৪ কোটি টাকা। কিন্তু এই মুহূর্তে কেবল খাতুনগঞ্জ শাখায় ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৬৭ হাজার কোটি টাকার বেশি।
চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম। তার গ্রুপকে গত ৭ বছরে ইসলামী ব্যাংক নিয়ম ভেঙে ঋণ সীমার ৩০ গুণেরও বেশি অর্থ ঋণ দিয়েছে।
চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম। তার গ্রুপকে গত ৭ বছরে ইসলামী ব্যাংক নিয়ম ভেঙে ঋণ সীমার ৩০ গুণেরও বেশি অর্থ ঋণ দিয়েছে।
এস আলম গ্রুপের কোম্পানিগুলোকে আলাদা কোম্পানি ধরে এই ঋণ দেওয়া হয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকও তাদের এই ছাড় দিয়েছে, যদিও এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, গ্রুপের সবগুলো প্রতিষ্ঠান মিলিয়েই এই ঋণসীমার হিসাব হবে।
ব্যাংকারদের প্রশিক্ষণ ও ব্যাংকিং ডিগ্রি প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট- বিআইবিএমের সাবেক মহাপরিচালক তৌফিক আহমদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ রকম কর্মকাণ্ডই তো বাংলাদেশের আর্থিক খাতকে দুর্বল করেছে। এমন ঘটনা যদি আর না হয় সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।”
কোন কোম্পানিকে কত ঋণ
নথিপত্রের হিসাব অনুযায়ী, কোম্পানিগুলোর মধ্যে এস আলম রিফাইন্ড সুগারের ৩ হাজার ৬০৯ কোটি টাকা, এস আলম সুপার এডিবল অয়েলের ৩ হাজার ২৩২ কোটি টাকা, চেমন ইস্পাতের ৩ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা, ইনফিনিটি সিআর স্ট্রিপসের ২ হাজার ২৮১ কোটি টাকা, মাসুদ প্রিন্টিংয়ের ১ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা, এস আলম কোল্ড রোলড স্টিল ২ হাজার ১২৬ কোটি টাকা, কর্ণফুলী ফুডের ১ হাজার ৭১৮ কোটি টাকা, এস আলম ভেজিটেবল অয়েলের নামে ১ হাজার ৫৫১ কোটি টাকাসহ খাতুনগঞ্জের এক শাখা থেকেই ২২ হাজার ১২৪ কোটি টাকা ফান্ডেড ঋণ আছে খাতুনগঞ্জ শাখায়।
এস আলম গ্রুপের এই কোম্পানিগুলো দেশের আরও বেশ কিছু শাখা থেকে ঋণ নিয়েছে। চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও ঢাকার বিভিন্ন শাখা মিলিয়ে এই ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৩৬ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা।
অন্যদিনে নন ফান্ডেড ঋণের মধ্যে ১৫ হাজার কোটি টাকা নেওয়া হয়েছে ঋণপত্র খোলার জন্য এবং বাকি ৩০ হাজার কোটি টাকা এস আলম পাওয়ার জেনারেশন লিমিটেডের জন্য ফরেন ব্যাংক গ্যারান্টি হিসেবে।
খাতুনগঞ্জ শাখার সাবেক এক ব্যবস্থাপক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই ঋণ দেওয়ার সময় আইন অনুযায়ী সব শর্ত মানা হয়নি। আগে ঋণ নিয়ে তারপর সেই টাকা থেকেই জামানত রাখার ঘটনাও ঘটেছে। পরে সে টাকাও উঠিয়ে নিয়েছে।”
তিনি বলেন, এস আলম কোল্ড রোলড স্টিল জামানত হিসেবে কেবল ১ কোটি ৫৩ লাখ টাকা, এস আলম সুপার এডিবল ৩ কোটি ৯১ লাখ টাকা, এস আলম রিফাইন্ড সুগার ৩০ কোটি ও এস আলম ভেজিটেবল ওয়েল ৯৬ লাখ টাকার জামানত দেখিয়ে ঋণ নিয়েছে।
২০১৭ সালে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার পর থেকে ইসলামী ব্যাংকে কী কী হয়েছে, তা প্রকাশ হতে শুরু করেছে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, “গ্রুপভুক্ত কোম্পানি ইসলামী ব্যাংকের সব শাখা থেকে তার নিয়ন্ত্রণমূলক মূলধনের ১৫ শতাংশের বেশি ঋণ পাবে না। কিন্তু এস আলম ক্ষমতা ব্যবহার করে বাড়তি ঋণ নিয়েছে।”
খাতুনগঞ্জের ব্যবস্থাপকদের পদোন্নতি
২০১৭ সালে এস আলম গ্রুপ ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর খাতুনগঞ্জ শাখায় সাত বছরে ৫ জন কর্মকর্তা ব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এই সময়েই ঋণগুলো অনুমোদন করা হয়, তাদের সবাইকেই পরে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বদলি করে দ্রুত পদোন্নতি দেওয়া হয়।
এরা হলেন মোহাম্মদ কায়সার আলী, সাব্বির, মিফতাহ উদ্দিন, মোহাম্মদ এহসানুল ইসলাম এবং মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম।
ইসলামী ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখার বর্তমান ব্যবস্থাপক জামাল আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নতুনভাবে এ ব্যাংকটি সংস্কার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ শাখা থেকে অনেক ঋণ বের হয়ে গেছে, যা ঋণ নেওয়ার সীমা অতিক্রম করেছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এটা নিয়ে কাজ করবে।
“আমি দায়িত্ব নেব রোববার, দায়িত্ব নেওয়ার পর বিষয়টি আরও খতিয়ে দেখা হবে।”
‘দায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের’
সীমার অতিরিক্ত ঋণ অনুমোদনে ইসলামী ব্যাংকের পর্ষদের চেয়ে বেশি দায় বাংলাদেশ ব্যাংককে দিতে চান বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ক্ষমতা ব্যবহার করে ব্যাংক খাত থেকে টাকা বের করে নিয়েছে গ্রুপটি। তাতে পুরো ব্যাংক খাত ভেঙে পড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হয়নি।”
সরকার পতনের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পাওয়া অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ইসলামী ব্যাংকে যা দুর্নীতি হয়েছে তা নিয়ে নিরীক্ষা প্রতিবেদন করা হবে। সব কিছু বিচারের আওতায় আনা হবে। তবে একটু সময় লাগবে।”
ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে যেভাবে এস আলম গ্রুপ
২০১৭ সালের ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নিতে প্রথমে পুঁজিবাজার থেকে শেয়ার কিনে পর্ষদে আসে এস আলম গ্রুপ। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ বিএসইসির করা একটি বিধান এই সুযোগ করে দেয়। ২ শতাংশ শেয়ার থাকলেই পরিচালক হওয়ার সুযোগ করে দেয় তারা।
এরপর আরও নানা ঘটনা ঘটে, যেটি ২০১৭ সালে বিস্তারিতভাবে প্রকাশ করে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট। সেখানে লেখা হয়, ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি একটি গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান, একজন ভাইস চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালককে ফোন করেন। এরপর তাদেরকে বাসভবন থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
সেদিনই ব্যাংকটির চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালককে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়।
ইকোনমিস্টের সেই লেখায় বলা হয়, কয়েক ঘণ্টা পর একটি হোটেলে সভায় বসে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। পদত্যাগ করা পরিচালকদের স্থলাভিষিক্ত কারা হবেন, তা নির্ধারণ করা হয়।
তারপর ধীরে ধীরে নামে বেনামে ৩০ শতাংশের বেশি শেয়ার কিনে নেয় এস আলম।
এস আলম গ্রুপ ব্যাংকটি নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার আগে বিদেশিদের শেয়ার ছিল ৫২ শতাংশের মত, যা এখন ১৩ শতাংশে নেমে এসেছে।
ধীরে ধীরে শেয়ার ছেড়ে দিয়েছে ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (আইডিবি), দুবাই ইসলামী ব্যাংক, আল-রাজি গ্রুপ, কুয়েতের সরকারি ব্যাংক কুয়েত ফাইন্যান্স হাউস, সৌদি কোম্পানি আরবসাস ট্রাভেল অ্যান্ড টুরিস্ট এজেন্সিসহ বেশির ভাগ উদ্যোক্তা ও সাধারণ শেয়ারধারী প্রতিষ্ঠান।
জামায়াত সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ইবনে সিনা, ইসলামিক সেন্টারও ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার ছেড়ে দেয়।