সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো গ্রুপ এবং বিতর্কিত ব্যবসায়ী চৌধুরী নাফিজ সরাফাত ও তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানের অর্থ পাচারের তদন্ত শুরু হয়েছে। গতকাল রোববার পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট তদন্ত শুরুর তথ্য জানিয়েছে।
সিআইডির মুখপাত্র বিশেষ পুলিশ সুপার মো. আজাদ রহমান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট এই দুজনের বিরুদ্ধে বিদেশে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ১৩ আগস্ট রাজধানীর সদরঘাট এলাকা থেকে আটক হন সালমান এফ রহমান। নিউমার্কেট থানায় দোকান কর্মচারী হত্যা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। পরে আরও দুটি হত্যা মামলার আসামি হন সালমান এফ রহমান।
সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, সালমান এফ রহমানের প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকোর বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগের তদন্ত শুরু হয়েছে। প্রাথমিক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বেক্সিমকো গ্রুপ গত ১৫ বছরে সাতটি ব্যাংক থেকে প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ নিয়ে তা বিদেশে পাচার করেছে।
বেক্সিমকো গ্রুপ জনতা ব্যাংক থেকে ২১ হাজার ৬৮১ কোটি, আইএফআইসি ব্যাংক থেকে ৫২১৮ কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে ২৯৫ কোটি, সোনালী, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক থেকে ৫৬৭১ কোটি ও এবি ব্যাংক থেকে ৬০৫ কোটি টাকাসহ মোট ৩৩ হাজার ৪৭০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এ ছাড়া বেক্সিমকো গ্রুপ গত কয়েক বছরে বাজার থেকে ২৭ হাজার কোটি টাকা প্রতারণা ও জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ আছে।
সৌদি আরবে যৌথ বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠিত বেক্সিমকো ফার্মাসিটিক্যিালসের বেশিরভাগ অর্থ বাংলাদেশ থেকে ওভার ইনভয়েসিং, আন্ডার ইনভয়েসিং ও হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করা হয়েছে। এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত শুরু হয়েছে।
এদিকে, বিতর্কিত ব্যবসায়ী চৌধুরী নাফিজ সরাফাত ও তার স্ত্রী আনজুমান আরা শহীদ এবং হাসান তাহের ইমাম ও তাদের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু করেছে সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট। প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওই ব্যক্তিরা সংঘবদ্ধভাবে প্রতারণা, জালিয়াতি, ওভার ইনভয়েস, আন্ডার ইনভয়েসের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ টাকা বিদেশে পাচার করেছে।
জানা গেছে, নাফিজ সরাফাত ২০০৮ সালে রেইস ম্যানেজমেন্ট পিসিএল নামে একটি সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানির লাইসেন্স নেন। তার সঙ্গে সহযোগী হিসেবে ছিলেন ড. হাসান তাহের ইমাম। সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানিটি সে সময়ে বিভিন্ন কর্মশালার মাধ্যমে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টদের মধ্যে বেশ সাড়া ফেলে দিয়েছিল।
রেইস ২০০৮ সালে যাত্রা শুরুর পর ২০১৩ সালের মধ্যেই ১০টি মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডে সম্পদ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পায়। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির অধীনে ১৩টি ফান্ড রয়েছে। মূলত এসব মিউচুয়াল ফান্ডকে ব্যক্তি স্বার্থে অর্থ উপার্জনের কাজে লাগিয়ে নাফিজ সরাফাত ও তার স্ত্রী আনজুমান আরা শহীদ এবং হাসান তাহের ইমাম ফান্ডের অর্থ বিনিয়োগ করে তৎকালীন ফারমার্স ব্যাংকের (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) শেয়ার কিনে ব্যাংকটির পর্ষদের পরিচালক বনে যান। ব্যাংকটি উদ্যোক্তাদের তালিকায় নাফিজ সরাফাতের স্ত্রীও ছিলেন। যদিও এ বিনিয়োগ থেকে ফান্ডগুলোর কোনো লাভ হয়নি। পরবর্তী সময়ে কৌশলে নাফিজ সরাফাত তার স্ত্রীকে সাউথ ইস্ট ব্যাংকের পরিচালক বানান। সম্প্রতি বেস্ট হোন্ডিংসের বন্ডে ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের জন্য নাফিজ সরাফাত চাপ দিয়েছিলেন বাংলাদেশ ইনফ্রাস্ট্রাকচার ফিন্যান্স ফান্ড লিমিটেডকে (বিআইএফএফএল)।
রেইস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে ১০টি মিউচুয়াল ফান্ড গঠন করেছে। ফান্ডগুলোর সম্মিলিত আকার প্রায় ৪৫০০ কোটি টাকা। ফান্ডের অর্থ দিয়ে নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য যে এফডিআর খোলা হয়, মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে সেই এফডিআরগুলো ভেঙে ফেলা হয়। এর ফলে ফান্ডে বিনিয়োগকারীরা কোটি কোটি টাকার মুনাফা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এসটিডি বা এসএনডি অ্যাকাউন্টে মাত্র ৩-৪ শতাংশ সুদে ফান্ডের ৬৫০-৭০০ কোটি টাকা জমা রাখা হয়। সুদের ২-৩ শতাংশ অর্থ ব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে আত্মসাৎ করা হয়। শেয়ারবাজার থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশের ন্যূনতম ৭৫ শতাংশ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বণ্টনের নিয়ম থাকলেও রেইস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ নিয়ম না মেনে লভ্যাংশের টাকা আত্মসাৎ করে থাকে।
বিজিআইসি নামে ব্রোকারেজ হাউসে (যার অধিকাংশ শেয়ার সিইও হাসান ইমামের আত্মীয়স্বজনের নামে কেনা) শেয়ার কেনার নিমিত্তে যে টাকা হয়, তার একটি বড় অংশ দিয়ে ফান্ডের নামে শেয়ার না কিনে আত্মীয়স্বজনের নামে কেনা হয়।
সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, এভাবে ফান্ডের বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বাজারের কোটি কোটি টাকার মুনাফা থেকে বঞ্চিত করে আত্মসাৎ করা হয়। মাঝে মাঝে ফান্ডের টাকা (৫০০-৭০০ কোটি) দিয়ে খুবই কৌশলে শেয়ার বাজারের কোনো একটি কোম্পানির বিপুল পরিমাণ শেয়ার কিনে ইচ্ছাকৃতভাবে শেয়ারের দাম বাড়িয়ে দিয়ে সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের কোটি কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতিসাধন করে থাকে।
মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর মেয়াদ (১০ বছর) উত্তীর্ণ হলেও ফান্ডে বিনিয়োগকারীদের মুনাফাসহ সমুদয় অর্থ ফেরত না দিয়ে এসইসি এবং আইসিবির যোগসাজশে মিউচুয়াল ফান্ডের মেয়াদ ফের ১০ (দশ) বছর করে বাড়ানো হয়।
চৌধুরী নাফিজ সরাফাত রেইস ম্যানেজমেন্টের চেয়ারম্যানের পাশাপাশি কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ট্রাস্টি বোর্ডেরও চেয়ারম্যান। ২০১৮ সালে রাজউক পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ১৭১.১৬ কাঠার একটি প্লট কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটিকে বরাদ্দ দেয়। এতে সরকারের ক্ষতি হয় ৭৭ কোটি টাকা।