গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়। এবার বিডিআর বিদ্রোহ নিয়ে মুখ খুলেছেন সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদ। তিনি মনে করেন, ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহ ও হত্যাকাণ্ড পরিকল্পিতভাবে হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় অবস্থান করা মইন ইউ আহমেদ গত বৃহস্পতিবার তাঁর নিজের ইউটিউব চ্যানেলে বিডিআর বিদ্রোহ নিয়ে নিজের ভাষ্য তুলে ধরেন। ‘মইন আহমেদ’ নামের ইউটিউব চ্যানেল ও বক্তব্য নিজের বলে জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোকে মুঠোফোনে নিশ্চিত করেছেন মইন ইউ আহমেদ।
ভিডিওতে জেনারেল মইন ইউ আহমেদ বলেন, ‘বিদ্রোহের পর ১৫ বছর ধরে আমরা শুধু সরকারের কথাই শুনে গেছি, প্রকৃত ঘটনা অনেক কিছুই আমাদের জানা নেই এবং জনগণও জানতে পারেনি। যখন আমি সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে তদন্তের আদেশ দিয়েছি তখন আমাকে বলা হলো যে, সরকার যখন তদন্ত আদালত করছে তখন সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে এই আদালতের প্রয়োজনটা কী?’
৫৭ জন সেনা অফিসারের হত্যার প্রেক্ষাপটে ভিন্ন ভিন্ন পর্যায়ে তদন্তের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে সাবেক এই সেনাপ্রধান বলেন, ‘এরপর তেমন কিছু সরকার থেকে উচ্চবাচ্য আসেনি, তবে এ তদন্ত আদালত করতে যেসব জিনিস প্রয়োজন তা সেভাবে সরকার থেকে আমরা সাহায্য পাইনি।’
বর্তমান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সেনাবাহিনীর সে সময়ের তদন্ত কমিটির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, যিনি সে সময় লেফট্যানেন্ট জেনারেল ছিলেন। জড়িতরা জেলে ছিল এবং তাঁদের সামনে আনা বা প্রশ্ন করা সম্ভব হয়নি বলে তদন্ত সঠিকভাবে সম্পন্ন করা যায়নি বলেও উল্লেখ করেন জেনারেল মইন।
মইন ইউ আহমেদ বলেন, ‘সেনাবাহিনীর তদন্ত চলাকালীন জেনারেল জাহাঙ্গীর কয়েকবার আমার কাছে এসে বেশ কয়েকবার তার সমস্যার কথা তুলে ধরেন।’
এখন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হওয়ায় পুনরায় তদন্ত করে জড়িতদের চিহ্নিত করার বিষয়ে জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে অনুরোধ জানিয়েছেন জেনারেল মইন। কী ঘটেছিল সেদিন এবং কার কেমন ভূমিকা সেগুলো তুলে ধরেছেন তিনি।
একটি বৈঠকে থাকার সময় ঘটনার দিন সকাল সাড়ে ৯টার দিকে পিলখানায় কিছু একটা ঘটার তথ্য জানতে পারেন বলে উল্লেখ করেন মইন ইউ আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আমার প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি কর্নেল ফিরোজ রুমে প্রবেশ করেন এবং আমাকে কানে কানে বলেন, পিলখানায় গণ্ডগোল হচ্ছে। আপনার দিকনির্দেশনা প্রয়োজন।’
মইন ইউ আহমেদ জানান, তিনি তখন ওই সভা স্থগিত করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও বিডিআরের ডিজির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। তাঁদের ফোন ধারাবাহিক ব্যস্ত ছিল। সামরিক গোয়েন্দারা তখন তাঁকে পরিস্থিতি সম্পর্কে জানান। ভয়াবহতা উপলব্ধি করে তিনি তখন সময় বাঁচাতে কারও নির্দেশ ছাড়াই সেনাবাহিনীর ৪৬ স্বতন্ত্র পদাতিক ব্রিগেডকে অপারেশনের জন্য প্রস্তুত হতে নির্দেশ দেন। তাঁরা তাৎক্ষণিকভাবে যুদ্ধপ্রস্তুতি শুরু করে, যার নামকরণ করা হয় ‘অপারেশন রি-স্টোর অর্ডার’।
জেনারেল মঈন বলেন, ‘পরিস্থিতির বিবরণে মনে হয়েছে, এগুলো সবই মনে হয় প্ল্যান করা এবং প্ল্যান অনুযায়ী সব চলছে। ৯টা ৫৪ মিনিটে আমি সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে মোবাইল ফোনে পেলাম। এর মধ্যেই তিনি বিডিআর বিদ্রোহ সম্পর্কে অনেক তথ্য পেয়ে গিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার পর দ্রুত সময়ের মধ্যে ব্রিগেড সেখানে পৌঁছায়।’
সাবেক এই সেনাপ্রধান বলেন, ‘লেফটেন্যান্ট কর্নেল শামসের ধারণা অনুযায়ী, সাড়ে ১০টা থেকে ১১টার মধ্যেই বেশিরভাগ অফিসারকে হত্যা করা হয়েছে, আর আমাদের ব্রিগেডটি পৌঁছায় ১১টার পরে। ক্যাপ্টেন শফিক তাঁর নেতৃত্বে ৩৫৫ জন র্যাব সদস্য নিয়ে পিলখানায় পৌঁছান ১০টার আগেই। এ সময় তিনি তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে অনুমতি চান পিলখানায় প্রবেশ করার জন্য যেটা তিনি পাননি।’
সেই দলটি যদি অনুমতি পেত তাহলে পরবর্তীতে সেনা ব্রিগেডের সমন্বয়ে বিষয়টা সহজে সামাল দেওয়া যেত বলেও উল্লেখ করেন জেনারেল মইন। তিনি জানান, বাইরে গোলাগুলির আওয়াজের মধ্যে গোয়েন্দা থেকে কোনো তথ্য তারা পাচ্ছিলেন না, শুধু মিডিয়ার লোকজন লাইভ কভার করছিল। বিডিআররা সে সময় ভুল তথ্য দিচ্ছিল বলেও জানান জেনারেল মইন।
জেনারেল মইন বলেন, ১১টা ৪৫ মিনিটের দিকে পিএসও এএফডি জানায়, সরকার রাজনৈতিকভাবে এ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে। বিদ্রোহীরা দাবি করেছে, কোনো আলোচনার আগে সেনাবাহিনীকে এই এলাকা থেকে চলে যেতে হবে। তাই সরকার আদেশ করল ৪৬ ব্রিগেড ও সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে যারা এসেছে তারা যেন দৃষ্টির বাইরে চলে যায়।
জেনারেল মইন জানান, বেলা ১২টায় জরুরিভিত্তিতে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যমুনায় দেখা করতে ডাকা হয় এবং সেনাবাহিনী চলে গেলে বেলা ১টার দিকে সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং হুইপ মির্জা আজম আলোচনার জন্য পিলখানায় যান।
যমুনায় দুপুরে পৌঁছানোর পর সেখানে বহু মানুষের সমাগম দেখেছেন বলে জানান সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল মইন। তিনি বলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম তিনি (শেখ হাসিনা) আমাকে ভেতরে ডেকে নেবেন, কিন্তু তা করা হলো না।’
ওই দিন শেখ হাসিনা মন্ত্রিসভার বৈঠক, আরও একটি বৈঠক সেরে এরপর তিন বাহিনীর প্রধানকে ডাকেন এবং রাজনৈতিক সমাধানের চেষ্টার কথা জানান।
মইন ইউ আহমেদ বলেন, ‘তখন আমি তাঁকে (শেখ হাসিনা) বলি, অনেকে নিহত হয়েছেন। তাদের কোনো দাবি মানা যাবে না। আপনি তাদের বলবেন, প্রথমত, অফিসার হত্যা এই মুহূর্তে বন্ধ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, যাঁদের আটক করা হয়েছে, তাঁদের সবাইকে এখনই মুক্তি দিতে হবে। তৃতীয়ত, অস্ত্রসহ বিদ্রোহীদের আত্মসমর্পণ করতে হবে এবং চতুর্থত, সাধারণ ক্ষমা দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।’
একটা পর্যায়ে শেখ হাসিনা বিদ্রোহীদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন বলে উল্লেখ করেন মইন ইউ আহমেদ। তিনি জানান, প্রথম পর্যায়ে আলোচনা তাঁর (মইন) জানা নেই। পরের পর্যায়ে তাঁকে ডাকা হয়। সেখানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে বিদ্রোহীদের আত্মসমর্পণের জন্য বলেন। বিদ্রোহীরা ৬টা ৩৭ মিনিটে যমুনা থেকে পিলখানার উদ্দেশে রওনা দেয়। সেখানে গিয়ে তারা ঘোষণা দেয়, সাধারণ ক্ষমার প্রজ্ঞাপন না হলে তারা আত্মসমর্পণ করবে না। তারা গোলাগুলিও শুরু করে। কর্মকর্তাদের খুঁজতে থাকে।
মইন ইউ আহমেদ বলেন, রাত ১২টায় তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন, শেখ ফজলে নূর তাপস ও তৎকালীন আইজিপি (পুলিশের মহাপরিদর্শক) পিলখানায় যান আলোচনার জন্য। একপর্যায়ে বিদ্রোহীরা কিছু অস্ত্র সমর্পণ করে এবং আটটি পরিবারকে মুক্তি দেয়। শুধু তিনটি পরিবার ছিল সেনা অফিসারদের। সাহারা খাতুন জানতেন অফিসারদের বন্দি করে রাখা হয়েছে। তিনি তাঁদের মুক্তির ব্যাপারে উদ্যোগ নেননি, কোনো খোঁজও নেননি।
এরপর ২৬ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকেই বিদ্রোহীরা আবারও গোলাগুলি শুরু করে এবং বেঁচে যাওয়া অফিসারদেরকে, যারা লুকিয়ে ছিল তাঁদের খুঁজতে থাকে। তারা কোয়ার্টার গার্ডে অফিসার এবং পরিবারদের হত্যার প্রস্তুতি নিতে থাকে। সকাল ১০টার দিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী আবার আমাকে যমুনায় যেতে বলেন।
এ দফায় সামরিক অভিযানের অনুমতি পান তিনি। ট্যাংকসহ সেনাবাহিনীর প্রস্তুতি দেখে বিডিআর সদস্যরা বিনা শর্তে আত্মসমর্পণে প্রস্তুত হয় বলে জানান তিনি।
ভিডিওর শুরুতে এবং শেষে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেন মইন ইউ আহমেদ। এ সময় বিডিআর বিদ্রোহ নিয়ে তাঁর লেখা বই খুব শিগগিরই প্রকাশ করা হবে বলে জানান তিনি।