গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগ সরকারের সময় পুলিশের এসআই ও সার্জেন্ট পদে নিয়োগের মাধ্যমে শতকোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। একজন চাকরিপ্রার্থীর কাছ থেকে ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের একটি সিন্ডিকেট এই বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেয়। এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরে একটি গোপন প্রতিবেদন জমা হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র এই তথ্য দিয়েছে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর তালিকা অনুযায়ী পুলিশে ব্যাপক নিয়োগ বাণিজ্য হতো। এই নিয়োগ প্রদানের ফলাফল প্রস্তুতসহ অন্যান্য কার্যক্রম অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে সম্পাদন করতেন তাঁর ঘনিষ্ঠ একজন এআইজিসহ আরো কয়েকজন সাবেক দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা। তাঁরা পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে নানা কৌশলে ঘুষ গ্রহণ করেন।
সম্প্রতি প্রাথমিক তদন্তে এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত শুরু হয়েছে। তাঁদের নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই শুরু হয় পুলিশে নিয়োগের নামে ঘুষ-দুর্নীতি। এ ক্ষেত্রে তিনি একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন।
তাঁর নির্দেশে চক্রটি এসআই (সাব-ইন্সপেক্টর) ও সার্জেন্ট নিয়োগে মেধাবী ও যোগ্যদের বঞ্চিত করে অযোগ্য ও অদক্ষদের নিয়োগ দেওয়া শুরু করে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ২০২৪ সালে আউটসাইড ক্যাডেটের নতুন একটি ব্যাচ নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। এরই মধ্যে এই ব্যাচের লিখিত পরীক্ষা পর্যন্ত সম্পন্ন হয়েছে। লিখিত পরীক্ষায় তিন হাজার ২০০ জন উত্তীর্ণ হয়েছেন। উত্তীর্ণ প্রার্থীদের কাছ থেকে আগের মতোই একইভাবে ওই চক্র বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করে।
এই নিয়োগে সাবেক এক এআইজি ও যুগ্ম সচিব সরাসরি দুর্নীতির টাকা লেনদেন করতেন। মাঠ পরীক্ষা থেকে চূড়ান্ত নিয়োগ পর্যন্ত পার করার উদ্দেশ্যে একেকজন পরীক্ষার্থীর কাছ থেকে ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকা প্যাকেজ আকারে তাঁরা গ্রহণ করেছেন বলে তথ্য পেয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
তদন্তসংশ্লিষ্ট পুলিশ সূত্র বলছে, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সময়ে দুর্নীতির মাধ্যমে অনেক এসআই নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর সারদায় পুলিশ একাডেমিতে মৌলিক প্রশিক্ষণরত বেশির ভাগ প্রার্থীর কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছিল বিপুল পরিমাণ অর্থ। চাকরি নিশ্চিতের নিমিত্তে প্রার্থীপ্রতি ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা নেওয়া হয় বলে প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে।
প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগ পেয়ে এরই মধ্যে বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করে তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, রাজধানীর উত্তরা এলাকার দুটি ফ্ল্যাটে চক্রের সদস্যরা এই ঘুষের টাকা লেনদেন করতেন। এই চক্রে রয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক তিন কর্মকর্তা এবং পুলিশ সদর দপ্তরের একজন সহকারী উপমহাপরিদর্শক (এআইজি)।
তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানতে পেরেছেন, ২০২৩ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এই ব্যাচের নিয়োগ কার্যক্রম শুরু হয়। তাদের মধ্যে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ পাঁচ হাজার ৮০০ জনের মধ্য থেকে ব্যাপক নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে ৮২০ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়।
এরই মধ্যে তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন সরকারের উচ্চ পর্যায়ে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৪০তম আউটসাইড ক্যাডেট ব্যাচের এই ৮২০ জন বর্তমানে এক বছর মেয়াদি মৌলিক প্রশিক্ষণে রয়েছেন সারদা পুলিশ একাডেমিতে। ২০২৩ সালের ৫ নভেম্বর তাঁদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়।
মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন মনে করেন, দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা অনিয়ম-দুর্নীতিকে এখনই ‘না’ বলা উচিত। যারাই দুর্নীতি করবে তাদের মুখোশ উন্মোচন করতে হবে। না হলে সমাজে যোগ্য ব্যক্তিরা পিছিয়ে পড়বেন। এতে বৈষম্য বাড়বে।
এ ব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশ সদর দপ্তরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘এই দুর্নীতির বিষয়ে একটি তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষেই বিস্তারিত বলা যাবে।’
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল পুলিশের এই নিয়োগ বাণিজ্যের অন্তরালে ছিলেন। তিনি তাঁর প্রভাব বিস্তার করে মন্ত্রণালয় এবং পুলিশ সদর দপ্তরে নিজর পছন্দের কর্মকর্তার সমন্বয়ে গঠন করাতেন নিয়োগ বোর্ড।
ওই নিয়োগ বোর্ডের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন পুলিশের সাবেক এক অতিরিক্ত আইজি। এ ছাড়া ওই বোর্ডে তাঁর কথিত ক্যাশিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের একজন যুগ্ম সচিব ছিলেন। এ ছাড়া ছিলেন একজন উপসচিব, পুলিশের একজন ডিআইজি ও এআইজি। তাঁরা মূলত এই নিয়োগ বাণিজ্যে সহায়তা করতেন।
প্রাথমিক তদন্তে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানতে পেরেছেন, এই নিয়োগে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পক্ষে একেকজন প্রার্থীর কাছ থেকে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা ঘুষ নিয়ে পছন্দের তালিকা প্রস্তুত করা হয়। আর চাহিদামতো ঘুষ না দিলে তাকে ভাইভায় ফেল করিয়ে দেওয়া হয়।
সার্বিক বিষয়ে পুলিশের নতুন নিয়োগ পাওয়া আইজি ময়নুল ইসলাম বলেন, ‘পুলিশকে এখন ঢেলে সাজানো হচ্ছে। গত ১৫ বছরে পুলিশের অনেক ক্ষতি হয়েছে।’