আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সংবিধান স্থগিত না করেই যেভাবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কার্যক্রম চলছে, তাতে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের বাধ্যবাধকতার কারণে নির্বাচন কমিশনের ‘সাংবিধানিক সংকটে’ পড়ার বিষয়টি সামনে এনেছেন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল।
রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে দেওয়ার পর ১৯ দিন চুপ থাকলেও শনিবার সংবাদপত্রে কলাম লিখে সেই ‘সংকটের’ কথা তুলে ধরেছেন শেখ হাসিনার সময়ে দায়িত্ব নেওয়া হাবিবুল আউয়াল। তার ভাষায়, ‘বিপ্লবের উদ্দেশ্যসমূহকে এগিয়ে নিতে’ অসামরিক ফরমান জারি করে সংবিধান পুরোপুরি অথবা আংশিক স্থগিত করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
‘বিপ্লব ও ফরমান: সরকার ও সংবিধান’ শিরোনামে ওই কলাম লেখার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেছেন, আলোচনার জন্য কাউকে তিনি পাচ্ছেন না। তাই নির্বাচন কমিশন যে ‘সাংবিধানিক সংকটে’ পড়েছে, সেটা পত্রিকায় লিখে জনগণকে অবহিত করাই সমীচীন মনে করছেন।
“ছাত্র-জনতার সফল বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ০৫ আগস্ট তারিখে আওয়ামী লীগের স্বৈরশাসনের পতন হয়েছে। বিপ্লবটি ছিল তারুণ্যের শক্তিতে উদ্দীপ্ত ব্যাপক জনসম্পৃক্ত প্রায় অবিশ্বাস্য অনন্যসাধারণ এক অসাধ্য সাধন। অসংখ্য অগণিত নিরীহ শিশু, কিশোর, তরুণ এবং বৃদ্ধকে জীবন দিতে হয়েছে। তবে বিশেষ একটি কারণে বিপ্লব-উত্তর এই সময়ে খানিকটা সাংবিধানিক শূন্যতা দৃশ্যমান হচ্ছে। সংবিধান কতটুকু বা কিভাবে বলবত আছে বোধগম্য হচ্ছে না। স্পষ্টতা প্রয়োজন। অস্পষ্টতা অনাকাঙ্খিত।
“ভবিষ্যতে আইনগত জটিলতা হতে পারে। সুদূর অতীতে সমস্যা ছিল না। তখন আইনকে বলা হত রাজার হুকুম। আধুনিক বিশ্বে আইন রাজার হুকুম নয়। আইন কাগজে লিখে গেজেট করতে হয়। আইনের সিদ্ধতা ও শাসন উপেক্ষণীয় নয়। বিপ্লবের মাধ্যমে স্বৈরশাসনের অবসান বা স্বৈরশাসকের অপসারণই চূড়ান্ত লক্ষ্য বা অর্জন নহে। আরাধ্য অনেক কর্ম সম্মুখে অপেক্ষমান। সেগুলো সমাধা করতে হবে। কঠিন প্রতিজ্ঞা, বিচক্ষণতা, সাহস ও সততায় অবিচল না থাকলে কর্মটি খুব সহজ হবে না।”
সাবেক আমলা হাবিবুল আউয়াল নিজের যুক্তি তুলে ধরতে গিয়ে স্বাধীনতার পর থেকে ৫৩ বছরে বাংলাদেশে আন্দোলন-অভ্যুত্থান-বিপ্লবের ইতিহাস তুলে ধরেছেন।
তিনি লিখেছেন, “৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ গণবিপ্লব বা গণঅভ্যুত্থান ছিল না। ওর থেকেও বড় কিছু ছিল। দেশ স্বাধীন হলো। অনেক প্রত্যাশা ছিল। ৭২-এ সংবিধান হলো। ৭৩-এ নির্বাচন হলো। বিতর্কিত নির্বাচন। ৭৪-এ বাকশাল হলো। সেটাও অন্তরালে বিতর্কিত ছিল। শেখ মুজিবের দ্বিতীয় বিপ্লব। বাকশালে যোগদান করতে বিশিষ্টদের লাইনের পর লাইন। ৭৫ এর ১৫ অগাস্ট শেখ মজিবুর রহমানকে এক সামরিক বিপ্লবে হত্যা করা হল। নভেম্বরে আবারো সামরিক বিপ্লব এবং পরে অচিরেই সৈনিক-জনতার অংশগ্রহণে এক সফল প্রতিবিপ্লব।
“৯০ তে স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য জনতার সফল বিপ্লব, ৯৬ তে আবারো অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য জনতার মঞ্চ নামক সফল বিপ্লবে খালেদা জিয়া ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিলেন। ভালো নির্বাচন হলো। ২০০১ এ গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলো। ২০০৭ এ আবারো অবাধ নির্বাচনের দাবিতে লগি-বৈঠার বিপ্লব হলো। তথাকথিত সেনাসমর্থিত অসাংবিধানিক সরকার দু’বছর ক্ষমতায় থেকে তেমন কিছু স্থায়ী সমাধান জাতিকে দিতে পারলো না। ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ এর নির্বাচন জাতির কাছে গ্রহণযোগ্য হলো না। বিপ্লবের মাধ্যমে অর্জিত স্থায়ী সফলতা জনগণ দেখতে চায়।“
এর মধ্যে ২০২৪ সালে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হাবিবুল আউয়ালের নির্বাচন কমিশনের অধীনেই হয়েছিল। বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর বর্জনের মধ্যে ওই নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর সন্তোষও প্রকাশ করেছিলেন সিইসি।
অভ্যুত্থান বা বিপ্লব পরবর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সংবিধান আংশিক বা পুরোপুরি স্থগিত করা কেন জরুরি, তার পক্ষে নিজের যুক্তিগুলো তুলে ধরেছেন এক সময় আইন ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন করা হাবিবুল আউয়াল।
তিনি লিখেছেন, “সামরিক অভ্যুত্থান হলে সামরিক ফরমান দ্বারা সংবিধানকে অবিলম্বে রহিত বা স্থগিত করা হয়। স্থগিত করা হলে ফরমানকে সর্বোচ্চ আইন হিসেবে অগ্রগণ্যতা দেয়া হয়। অর্থাৎ, ফরমান ও স্থগিত সংবিধানের মধ্যে বিরোধের ক্ষেত্রে ফরমানকে প্রাধান্য দেয়া হয়। আইনের শাসনের ধারাবাহিকতাকে এভাবে বজায় রাখা হয়। বিপ্লবী সরকার শপথ নিয়েছেন। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ থেকে আগাম বৈধতা নেওয়া হয়েছে। পরে আপিল বিভাগকেই বিদায় করা হয়েছে।
“আমার সোজা-সাপটা কথা হচ্ছে গণঅভ্যুত্থান কার্যকর করতে আদালতের অনুমোদন প্রয়োজন হয় না। গণঅভ্যুত্থান একটি স্বতঃসিদ্ধ বাস্তবতা (self-evident fact)। আইনের ঊর্ধ্বে এর অবস্থান। তবে বিপ্লব-উত্তর সময়ে আইনের ঊর্ধ্বে একটি ফরমান অনিবার্যভাবে প্রয়োজন। সামরিক আমলারা তা জানেন। সুশিল আমলারা সেটা বোধকরি জানেন না।”
হাবিবুল আউয়াল লিখেছেন, “গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার পতন হলে ইতোপূর্বে বহাল থাকা সরকারকে অপসারণ করে বিপ্লবী সরকার গঠিত হলে সংবিধান অকার্যকর হয়ে যায়। উদ্ভূত এমন পরিস্থিতিতে অবিলম্বে একটি অসামরিক ফরমান জারি করে প্রচলিত সংবিধানকে বাতিল করে, বা স্থগিত রেখে, বা পাশাপাশি বহাল রেখে, অসামরিক ফরমানকে সংবিধানের ঊর্ধ্বে অবস্থান প্রদান করা হলে সাংবিধানিক বা আইনগত সংকট পরিহার করা যেতে পারে। এটি বহুল অনুসৃত পদ্ধতি।”
ইতিহাস থেকে এর নজির তুলে ধরতে গিয়ে ১২১৫ সালে বিলেতের ম্যাগনাকার্টা, ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব এবং ১৯১৭ সালের রুশ তথা বলশেভিক বিপ্লবের কথা বলেন সিইসি।
তবে প্রায় প্রতিটি সফল বিপ্লবকে যে প্রতিবিপ্লবের ধকল সামলাতে হয়েছে, সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, “১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের পরবর্তী সময়টা কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। একের পর এক প্রতিবিপ্লব কঠোর হস্তে দমন করে ১৭৯৩ সালে পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছিল। ১৭৯৯ সালে সেনাপতি নেপোলিয়ন বোনাপার্টে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তগত করে পরে নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করেছিলেন।
“১৯১৭ সালের রুশ বলশেভিক বিপ্লবকে অনেক কয়টি প্রতিবিপ্লব দমন করে অবশেষে ১৯২৩ সালে চূড়ান্ত বিজয় বা সফলতা অর্জন করতে হয়েছিল। দাস প্রথাকে নিয়ে ১৮৬১-৬৫ সালে সংঘটিত আমেরিকার গৃহযুদ্ধ ছিল বিপ্লব ও প্রতিবিপ্লবের সংমিশ্রিত এক জটিল আখ্যান। দাস প্রথা বহাল রাখা ও বিলোপ সাধনের জন্য আমেরিকার উত্তর ও দক্ষিণের রাজ্যগুলোর মধ্যে সেটি ছিল এক মরণপণ দ্বৈরথ।”
কাজী হাবিবুল আউয়াল তার কলামে সমসাময়িক বিশ্বের উদাহরণও টেনেছেন। তিনি লিখেছেন, “সাম্প্রতিক সময়ে রোমানিয়া, ইরান, ইরাক, মিশর, সিরিয়া, ইয়েমেন, লিবিয়াসহ আরো অনেক দেশে ঘটে যাওয়া গণঅভ্যুত্থান আধুনিক ডিজিটাল গণমাধ্যমের সুবাদে আমাদের চোখের সামনেই দৃশ্যমান হয়ে সংঘটিত হয়েছে। আরব বসন্তে মিশরের সফল বিপ্লব অচিরেই কুটিল চক্রান্তে ব্যর্থ হয়ে গেল। মুরসির করুণ মৃত্যু আমাদের চোখের সামনেই ঘটল।
“বিপ্লব-উত্তর সময়ে আইন-কানুন ভেঙ্গে পড়ে। আরব বসন্ত তিউনিসিয়াতে সফল হলেও বাকি দেশগুলোতে বরং উত্তরকালে ব্যর্থই হয়েছিল। আইন-কানুন ও জনশৃঙ্খলা পুনর্বহাল বিপ্লবী সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। আইনের শাসন পুনর্বহাল করে সমুন্নত রাখতে সাময়িক বিপ্লবী আইন তথা সামরিক বা অসামরিক ঘোষণাপত্র আইন বা আদেশ (প্রক্লেমেশন অর্ডার) প্রণয়ন করে প্রয়োগ করা হয়ে থাকে।”
তিনি লিখেছেন, “আইন বিজ্ঞানে De Jure (আইনানুগ) এবং De facto (বাস্তবানুগ) সংঘাত নিরসনের এহেন অনুসৃত পদ্ধতি নতুন নয়। অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে। অনুসরণ করাই বাঞ্ছনীয়। মার্ক্স, এঙ্গেল, হেগেল, রুশো, ক্যান্টসহ অনেক দার্শনিক ও আইনবিজ্ঞানীদের বিস্তর লেখা-লেখি এসকল বিষয়ে রয়েছে। তাঁরা শক্তিতত্ত্ব (Force Theory) বা উপযোগিতাতত্ত্ব (Utilitarian Theory) দিয়ে গণবিপ্লব বা গণঅভ্যুত্থানের যথার্থতা প্রতিপাদন করেছেন।”
এখন বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার ‘বিপ্লবের’ পর নির্বাচন কমিশন কীভাবে সংকটে পড়েছে, তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে হাবিবুল আউয়াল লিখেছেন, “নির্বাচন কমিশন হয়তো অচিরেই বিগত হবে। কিন্তু এতে করে সংকটের নিরসন হবে না। সংসদ অসাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় ভেঙে দেওয়া হয়েছে। বাস্তবতার নিরীখে ভেঙে দিতে হয়েছে।
“সফল বিপ্লবের De facto (বাস্তবানুগ) গ্রামারে এটি অবশ্যই সিদ্ধ। সংবিধান যদি বহাল থাকে তাহলে নির্বাচন কমিশনকে সংবিধানের ১২৩(৩)(খ) অনুচ্ছেদের বিধানমতে তৎপরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে। যদি না করেন, তাহলে সেক্ষেত্রে ৭খ অনুচ্ছেদের বিধানমতে কমিশনারগণ মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ করে থাকবেন। সংবিধানকে পুরোপুরি অক্ষুণ্ন রেখে বিপ্লবকে তথা বিপ্লবের উদ্দেশ্যসমূহকে এগিয়ে নেওয়া ও বাস্তবায়ন করা যায় না।”
জেলা ও দায়রা জজ থেকে সচিব হয়ে অবসরে যাওয়া এই আইনের ছাত্র লিখেছেন, “৯০ দিনের মধ্যে জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা বিদ্যমান পরিস্থিতিতে অসম্ভব। এটাকে বলা হয় উভয় সংকট। ঘাড়ের উপর ডেমোক্লিসের তরবারি।
“নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন এবং নির্বাচন কমিশনারদের অপসারণ যখনই হোক না কেন, রাষ্ট্র ও সরকারের আইনগত ও সাংবিধানিক ভিত্তি মজবুত করতে হলে সফল বিপ্লব-উত্তর উদ্ভূত এমন পরিস্থিতিতে অবিলম্বে একটি অসামরিক ফরমান জারি করে প্রচলিত সংবিধানকে স্থগিত রেখে বা, পাশাপাশি বহাল রেখে, অসামরিক ফরমানকে সংবিধানের ঊর্ধ্বে অবস্থান প্রদান করে সাংবিধানিক বা আইনগত সংকট পরিহার করা প্রয়োজন।”
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের যে কথা বলছে, সেজন্যও ওই ফরমান জারির তাগিদ দিয়ে সিইসি লিখেছেন, “সংবিধানে পরিবর্তন ব্যতিরেকে অনেক কাঙ্ক্ষিত সংস্কার হয়তো আইনত সম্ভব হবে না। যথাযথ ফরমান থাকলে তার অধীনে সংবিধানে সংস্কার আনা সম্ভব। অতীতে করা হয়েছে। জিয়াউর রহমান করেছেন। হোসেন মোহাম্মদ এরশাদ করেছেন। এবং, সেসব আজ অব্দি বহাল আছে। দৃষ্টান্ত থাকলে অনুসরণ করাই বিধেয় হবে।”