‘আয়নাঘর’ সম্পর্কে যা বলল ভারতীয় গণমাধ্যম

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক গণবিক্ষোভ ও তার জেরে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর একটি বিশেষ শব্দ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে সংবাদমাধ্যমে ঘুরতে শুরু করেছে। শব্দটি ‘আয়নাঘর’। শব্দটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে, তার নেপথ্যে যেন থমকে থাকছে অবিমিশ্র ঘৃণা এবং আতঙ্ক। কী এই ‘আয়নাঘর’?

‘আয়নাঘর’ আসলে আওয়ামী আমলে ডাইরেক্টরেট জেনারেল অফ ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স (ডিজিএফআই) পরিচালিত এক গোপন বন্দীশালা। এর জন্ম শেখ হাসিনার আমলেই। মূলত সরকার-বিরোধী চক্রান্তে সন্দেহভাজনদের আটক রাখা হতো সেখানে। উল্লেখ্য ডিজিএফআই দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের গোয়েন্দা সংস্থা।

গত ৬ আগস্ট ব্যারিস্টার আহমেদ বিন কাসেম আরমান এবং সাবেক সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আযমী আট বছর ‘নিখোঁজ’ থাকার পর জনসমক্ষে আসেন। শেখ হাসিনা সরকার তাদের ‘আয়নাঘর’-এ আটক রাখে বলে অভিযোগ এসেছে।

আরমান ও আযমী দু’জনেই জানিয়েছেন, আট বছর ধরে সেখানে তারা বিনাবিচারে কদর্য অবস্থায় বন্দীদশা কাটিয়েছেন।

৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। তারপর থেকেই শুরু হয় ‘আয়নাঘর’ নিয়ে চর্চা। হাসিনা-শাসনে বহু ব্যক্তিই আচমকা নিরুদ্দেশ হয়েছেন বলে জানা যাচ্ছে। তারা প্রত্যেকেই আওয়ামী সরকারের বিরোধিতা করেছিলেন এবং প্রকাশ্যে হাসিনার সমালোচনা করেছিলেন। ঠিক যেভাবে নাৎসি জমানায় জার্মানিতে বিরোধী পক্ষকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে আটক রাখা হতো, সেই আঙ্গিকেই ‘আয়নাঘর’ চলতো। এমনটাই জানিয়েছেন সেখান থেকে বেরিয়ে আসা বন্দীরা।

Pause

Unmute
Remaining Time -3:12

Close PlayerUnibots.com
শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই নাকি এমন ২৩টি বন্দীশালা ছিল। তার মধ্যেই একটি ‘আয়নাঘর’। মানবাধিকার নিয়ে কর্মরত কয়েকটি সংস্থার সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০০৯ সালে প্রায় ৬০০ ব্যক্তি রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হন। এদের সকলকেই বলপূর্বক তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ। এবং এই সব অপহরণের নেপথ্যে সেনাবাহিনীর হাত ছিল বলেও অভিযোগ তোলা হয়।

বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের দাবি, শুধু তৎকালীন সরকারের সমালোচকেরা নন, ‘চরমপন্থী’ বা ‘সন্ত্রাসবাদী’ হিসেবে চিহ্নিত করেও বহু মানুষকে ‘আয়নাঘর’ বা সেই জাতীয় গোপন বন্দীশালাগুলোতে আটক করা হয়েছিল। যাদের মধ্যে কিছু মানুষকে পরে মুক্তি দেয়া হয়। বেশ কিছু মানুষকে হত্যা করা হয়। খুব কম জনকেই বিচারের জন্য আদালতে তোলা হয়। বেশ কিছু মানুষকে হত্যা করা হয়। খুব কম জনকেই বিচারের জন্য আদালতে তোলা হয়।

২০২২ সালের ১৪ আগস্ট সুইডেনের এক সংবাদমাধ্যম ‘নেত্র নিউজ’ (সংস্থাটি মূলত বাংলাদেশ-সংক্রান্ত সংবাদ পরিবেশন করে) এক তদন্তমূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানেই প্রথম দাবি করা হয়, ‘আয়নাঘর’ নামে এক গোপন কারাগারে আকস্মিকভাবে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া মানুষদের আটক রেখে নির্যাতন করা হচ্ছে। ‘নেত্র নিউজ’ সেই কারাগারের সম্ভাব্য অবস্থানও জানিয়েছিল। তাদের এই দাবির ভিত্তি হিসেবে হাসিনুর রহমান এবং শেখ মোহাম্মদ সেলিমের বয়ান প্রকাশ করে। তারা ‘আয়নাঘর’-এ আটক ছিলেন বলে দাবি করেন।

২০১৮ সালের ৮ আগস্ট বাংলাদেশের সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) সদস্য হাসিনুরকে ১৪-১৫ জন লোক তার মিরপুরের আবাস থেকে তুলে নিয়ে যায়। ২০২২ সালে তাকে তার বাড়ির সামনে রেখে আসা হয়। ওই সময় তিনি অসুস্থ। তার কথাবার্তা অসংলগ্ন ছিল এবং উচ্চ রক্তচাপের সমস্যায় তিনি ভুগছিলেন বলে তার পরিবার সূত্রে জানা যায়।

হাসিনুর জানান, ১৬ মাস তাকে ‘আয়নাঘর’-এ আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়েছিল। চট্টগ্রামে জামাত-উল-মুজাহিদিন গোষ্ঠীর বেশ কয়েকজন সদস্যকে ২০০৫-০৬ নাগাদ হাসিনুর গ্রেফতার করেছিলেন। তারা নাশকতামূলক কাজে জড়িত ছিলেন বলেই জানা যায়। তা সত্ত্বেও ‘দেশদ্রোহিতা’র অভিযোগে হাসিনুরকে ওই সময় পদচ্যুত করা হয়।

‘নেত্র নিউজ’ ওই সময় কোনো কারাগৃহের বেশ কিছু ছবি প্রকাশ করে দাবি জানায়, সেগুলো ‘আয়নাঘর’-এর। তাদের আরো দাবি, ওই ছবিগুলো সেখানে কর্মরত সামরিক কর্মকর্তাদেরই তোলা। দাবি করা হয়, বাংলাদেশের কাউন্টার-টেররিজম ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো এবং ডিজিএফআই ‘আয়নাঘর’-এর দায়িত্বে রয়েছে। ‘নেত্র নিউজ’ আরো জানায়, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকার কোনো ভবনেই এই গোপন কারাগারটি তৈরি করা হয়েছে।

‘নেত্র নিউজ’-এর এই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার বিভাগের প্রধান মিশেল ব্যাশেলেটের বাংলাদেশ সফরের প্রাক্কালে। মিশেল ঢাকায় এসে এই সব আচমকা নিখোঁজ হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের সম্পর্কে খোঁজখবর নেন এবং প্রত্যাবর্তনের আগে ঢাকায় আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে এই সব নিরুদ্দেশ সম্পর্কিত খবরে সিলমোহর দেন। একই সাথে তিনি আইন-বহির্ভূত হত্যা ও নিখোঁজ ব্যক্তিদের ব্যাপারে নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি করেন।

‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’ নামের এক আন্তর্জাতিক স্তরে মানবাধিকার নিয়ে কর্মরত অসরকারি প্রতিষ্ঠানের মুখপাত্র মীনাক্ষী গঙ্গোপাধ্যায়ের দাবি, বাংলাদেশ সরকারই এই ব্যক্তিদের নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার জন্য দায়ী। পাশাপাশি, মিশেলের দাবির সমর্থনে নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিজনকে নিয়ে গঠিত মঞ্চ ‘মায়ের ডাক’ এক মিছিলের আয়োজন করে। মঞ্চের আহ্বায়ক সানজিদা ইসলাম ডিজিএফআই-এর বিরুদ্ধে কোনো গোপন বন্দীশালা পরিচালনার ব্যাপারে অভিযোগ তোলেন। সানজিদার অভিযোগ ‘আয়নাঘর’-এর দিকেই ইঙ্গিত করেছিল।

শেখ মোহাম্মদ সেলিম নামে এক সাবেক সামরিক অফিসারকে ফোন করে ডেকে এনে ‘আয়নাঘর’-এ আটক করা হয় বলে অভিযোগ। তার দাবি, তাকে ওই বন্দীশালায় বহু বছর আটক রাখা হয়। ‘নেত্র নিউজ’ সেলিমকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানায়, ওই কারাগারের কক্ষগুলোতে কোনো জানালা ছিল না। অনেক উঁচুতে একটি ছোট বাল্ব থেকে সামান্য আলো পাওয়া যেত। কোথাও বিশালাকার অ্যাডজাস্ট ফ্যান সারাদিন চলত, যার আওয়াজে বাইরের কোনো শব্দই কারাকক্ষে পৌঁছাত না। তিনি মাঝেমাঝে কম্পন অনুভব করতেন, যা থেকে তার ধারণা, কাছাকাছি কোথাও বিমানবন্দর বা বিমানঘাঁটি রয়েছে।

সেলিম ‘নেত্র নিউজ’কে জানিয়েছিলেন, ঠিক কতজন মানুষ সেখানে বন্দী ছিলেন, তা তার অনুমানের বাইরে ছিল। প্রায়ই তাকে মারধর করা হতো এবং তার ওপর অন্য শারীরিক নির্যাতনও চলত। এক দিন প্রবলভাবে তাকে মারা হয় এবং তাকে অন্য ঘরে ফেলে আসা হয়।

পরে জানা যায়, সেলিমকে তুলে আনা ডিজিএফআই-এর উদ্দেশ্য ছিল না। ভুল করেই তাকে তারা তুলে আনে। পরে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এরপর সেলিম মালয়েশিয়া চলে যান।

৭ আগস্ট ইউনাইটেড পিপল্‌স ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্টের নেতা মাইকেল চাকমা ‘আয়নাঘর’ থেকে মুক্তি পেয়েছেন বলে জানা গেছে। মাইকেল ২০১৯-এর এপ্রিল থেকে নিখোঁজ ছিলেন। তার আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া তার সন্ধান পাওয়ার জন্য আদালতে একটি হেবিয়াস কর্মাস পিটিশন দাখিল করেছিলেন। তিনি মাইকেলের বাড়ি ফেরার খবরটি যে সত্য, তা সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন।

এক সামরিক অফিসার ‘নেত্র নিউজ’কে জানান, ‘আয়নাঘর’-এ ৩০টির মতো কক্ষ ছিল। সেলিম ‘ভয়েস অফ আমেরিকা’কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জানান, যদিও সব ক’টি কক্ষই শব্দনিরোধক ছিল, তবু প্রায়ই সেই সব ঘর থেকে ক্ষীণ আর্ত চিৎকার ভেসে আসত। মাঝেমাঝে কোনো ব্যক্তিকে ‘আয়নাঘর’ থেকে মুক্তি দেয়া হলেও পরে তারা এ ব্যাপারে নীরবতাই পালন করতেন। আবার ধরপাকড়ের ভয় তাদের তাড়া করে বেড়াত।

সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে ‘আয়নাঘর’ নিয়ে কথাবার্তা প্রকাশ্য আসছে। বহু নিখোঁজ ব্যক্তির পরিবারই আশা করছে, তারা ফিরে আসবেন।

৭ আগস্ট ডিজিএফআই সংবাদমাধ্যমকে জানায়, এই মুহূর্তে আর কোনো ব্যক্তি আটক নেই। ২০১১ সালে আতাউর রহমান নামে মাদারিপুরের এক ব্যক্তি নিখোঁজ হয়ে যান। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমকে তার স্ত্রী নাদিরা সুলতানা জানান, তিনি তার স্বামীকে ফিরিয়ে আনতে ঢাকা রওনা দিচ্ছেন। নাদিরার মতো বহু মানুষই এখন নিখোঁজ পরিজনের ফিরে আসার অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন। তবে তারা সকলেই জীবিত রয়েছেন কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *