কোনোভাবেই সংঘাত এড়ানো গেল না। বিএনপি’র শনিবারের মহাসমাবেশ নিয়ে সারা দেশ এখন উত্তপ্ত। বিএনপি’র সমাবেশে হামলা করেছে পুলিশ। বিএনপিও এর পাল্টা জবাব দিয়েছে। হামলা, পাল্টা হামলায় পুলিশসহ দুইজন নিহত হয়েছেন। হামলা ও যুবদল কর্মী হত্যার প্রতিবাদে বিএনপি রোববার হরতাল পালন করেছে। হামলা, মামলা, ধরপাকড়ের মুখে হরতালের দিন বিএনপিসহ অন্যান্য দল মাঠে ছিল না তেমন। এরপরও সারা দেশেই হরতাল পালিত হয়েছে। রাস্তাঘাটে যানবাহন তেমন চলেনি। মানুষজনও ছিল কম।
যদিও হরতালের প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের নিয়ে শান্তি মিছিল করেছে। বিএনপি’র পাল্টা কর্মসূচি হিসেবে বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ প্রান্তে সব সময়ই আওয়ামী লীগ সমাবেশের আয়োজন করে। কিন্তু উপস্থিতির তুলনা করলে আকাশ পাতাল পার্থক্য এখন বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সমাবেশগুলোতে। আওয়ামী লীগ চেষ্টা করছে নানাভাবে বিএনপিমুখী সমাবেশের জনস্রোত ঠেকাতে।
হামলা, মামলা কোনো কিছুই বাদ রাখছে না। ফলে সব মিলিয়ে দেশের রাজনীতি এখন মুখোমুখি অবস্থানে। বিএনপি দাবিতে অটল রয়েছে। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে হবে। তা না হলে বিএনপি নির্বাচনে যাবে না। নির্বাচন প্রতিহতের চেষ্টা করবে। এই দাবি নিয়ে বিএনপি গত প্রায় এক দশক ধরেই আন্দোলন করছে। কিন্তু তারা এখনো দাবি আদায় করতে পারেনি। বিপরীতে আওয়ামী লীগ বলছে সংবিধানের বাইরে কিছুই করার নেই। সংবিধান অনুসারেই নির্বাচন হবে। আওয়ামী লীগও এক সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করেছে। ১৭৩ দিন হরতাল করেছে। অবরোধ করেছে। অফিসগামী সরকারি কর্মচারীকে দিগম্বর করেছে। বিএনপি ওই সময় আওয়ামী লীগের দাবি মেনে নিয়েছিল। কিন্তু এখন আওয়ামী লীগ কোনো ক্রমেই বিএনপি’র দাবি মানতে চাইছে না। আওয়ামী লীগ বলছে- সংবিধান মোতাবেক নির্বাচন হবে। আমার মনে হয় না সংবিধানের বাইরে গিয়ে বিএনপি বা অন্যরা নির্বাচনের দাবি করেছে। বিএনপি নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা বলছে। বিএনপি’র দাবি মানার জন্য সংবিধানের বাইরে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। শুধু সংবিধান সংশোধন করলেই হয়। সংবিধানে তো নতুন নতুন বিধিবিধান সংযোজন ও বিয়োজনের সুযোগ আছে। আর সংবিধান অপরিবর্তন যোগ্য কোনো বিষয় না। সংবিধান জনগণের জন্য তৈরি করা হয়। আর এই সংবিধান তৈরি করে জনগণ। সংসদ জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে কেবল। দিন শেষে এই রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। তাই জনগণের সুবিধার্থে সংবিধান, আইনকানুন সবই পরিবর্তন, সংশোধন ও পরিমার্জন করা হয়। তাই সংবিধানের বাইরে যাওয়ার কিছু নেই এখানে।
প্রশ্ন হচ্ছে বিএনপি’র দাবি অনুসারে আওয়ামী লীগের সংবিধান সংশোধন করতে সমস্যা কোথায়? এর আগে তো বিএনপি আওয়ামী লীগের দাবি মেনে নিয়েছিল। বরং বর্তমানে আওয়ামী লীগের একগুয়েমি আচরণ দেশকে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের প্রেক্ষিতে বা অন্যান্য স্থানীয় নির্বাচনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের খুব বেশি আগ্রহ নেই। সম্প্রতি বিভিন্ন সংসদীয় আসনের উপনির্বাচনে ভোটের হার ছিল খুবই হতাশাজনক। এই অবস্থা থেকে নির্বাচন ও ভোটের পরিবেশকে আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনতে হলে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিকল্প নেই।
কিন্তু কোনো ভাবেই রাজনীতির স্বাভাবিক পরিবেশ বজায় রাখতে দিচ্ছে না সরকার। দীর্ঘদিন ধরেই বিএনপিসহ অন্যান্য দলগুলো শান্তিপূর্ণভাবে সভা সমাবেশ করছে। হরতাল, অবরোধ পালন করেনি। কিন্তু বরাবরই বিরোধী দল বিশেষ করে বিএনপি’র সভা-সমাবেশে হামলা, গুলি করেছে পুলিশ। দিন দুপুরে প্রকাশ্যে বিএনপি’র সমাবেশে ডিবি ও আনসার সদস্যরা বন্দুক উঁচিয়ে গুলি করেছে। শান্তিপূর্ণ রাজনীতিকে সহিংসতার দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য সব সময়ই সরকারের পক্ষ থেকে উস্কানি ছিল। তবে বিএনপিকেও আরও কৌশলী হওয়ার প্রয়োজন ছিল। তাদের মনে রাখতে হবে যেকোনো মূল্যে আন্দোলন কর্মসূচিকে শান্তিপূর্ণ রাখতে হবে। সহিংসতা পরিহার করতে হবে। জনগণকে সঙ্গে নিয়েই দাবি আদায় করতে হবে।
তবে মাঠে রাজনীতি আমাদের খুব বেশি আশা জোগাচ্ছে না। দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল অনড় অবস্থানে থাকার কারণে সামনের দিনের রাজনীতি আরও সহিংস হতে পারে। বিএনপি’র পক্ষ থেকে হরতাল, অবরোধ, ঘেরাওয়ের মতো কর্মসূচির ঘোষণা আসতে পারে। টানা কর্মসূচি দেশের জন্য, অর্থনীতির জন্য ভালো হবে না। বরং বর্তমান অর্থনৈতিক দুরবস্থাকে আরও কঠিন করে তুলবে। দিন দিন খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ছে। আগে বলা হতো নাগালের বাইলে চলে গেছে দ্রব্যমূল্য। এখন এই কথা বলা সম্ভব না। দাম নাগালের এত যোজন যোজন দূরে চলে গেছে যে পরিস্থিতি বুঝাতে নতুন নতুন শব্দবন্ধ সৃষ্টি করতে হবে। রোববার পিয়াজের দাম ১০০ টাকার বেশি প্রতি কেজিতে বিক্রি হয়েছে রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে। তিন দিন আগে ছিল ৮০ টাকা কেজি। অনেক মানুষ এখন আর কেজি হিসেবে আলু কিনে না। প্রতি পিস হিসেবে কিনে এখন মানুষ বাজারে গিয়ে। দুই তিনটি আলু কিনে চলে আসে। ডিমের দাম অনেক আগেই প্রতি পিস ১৫ থেকে ১৬ টাকা হয়েছে। এক গণমাধ্যম কর্মী দৈনন্দিন জীবনে ব্যয় নির্বাহের দুরবস্থা তুলে ধরতে গিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন, জীবনে কোনো বিলাসিতা নেই। খুব সাদামাটা জীবনে অভ্যস্ত। বিলাসিতা বলতে ছিল নাজিরশাইল চালের ভাত খাওয়া। ২৫ কেজির বস্তা এখন ২৬২৫ টাকা। প্রতি কেজি ১০৫ টাকা। না পারি ছাড়তে। না পারি ধরতে। জীবন দিন দিন কঠিন থেকে কঠিন হচ্ছে। আড়াল করে কি লাভ। বলেই ফেললাম। তিনি জানতে চেয়েছেন, আপনাদের কি অবস্থা।
এই রকম অর্থনৈতিক দুরবস্থার মধ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা জনসাধারণকে আরও বিপাকে ফেলে দিবে। একদিন হরতাল, অবরোধ মানেই জিনিসপত্রের আরও মূল্যবৃদ্ধি। জনসাধারণের দুর্ভোগ। উন্নয়নের কথা ফলাও করে বলা হচ্ছে বটে কিন্তু এই উন্নয়নের সুফল মানুষ পাচ্ছে না। নিদারুণ এক অবর্ণনীয় চাপা কষ্টের মধ্যদিয়ে সাধারণ মানুষ দিনাতিপাত করছে। ওই গণমাধ্যম কর্মী হয়তো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন। কিন্তু অন্যরা সামাজিকতার কারণে লিখতে পারছেন না। তবে বেশিদিন মানুষের পক্ষে মুখ বুঝে থাকা সম্ভব না। বিরোধী দলগুলোর সমাবেশগুলোতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ বাড়ছে। জনসাধারণ কথা বলতে শুরু করেছে। শনিবার বিএনপি’র কর্মসূচি চলাকালে বাসে আগুন দেয়ার পর চালক নিজেই জানিয়েছেন ডিবি পুলিশের ভেস্ট পরিধান করে মোটরসাইকেলে দুইজন এসে এই কাজ করেছে। আর আগেই জুলাই মাসে শনির আখড়ায়ও বিএনপি’র অবস্থান কর্মসূচি চলার সময় একই ভাবে দুইজন মোটরসাইকেলে এসে পুলিশের সামনেই আগুন দিয়েছে। ওই সময়ও চালক নিজেই গণমাধ্যমকে বিস্তারিত জানিয়েছেন।
রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক দুরবস্থার কারণে ক্ষুব্ধ মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ভয়কে জয় করতে শুরু করেছে। জনমানুষের মধ্যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ বিস্ফোরিত হওয়ার আগেই রাজনীতিবিদদের বিশেষ করে সরকারি দলের সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। একগুয়েমি পরিহার করে সুষ্ঠু স্বাভাবিক রাজনৈতিক পরিবেশ ফিরিয়ে এনে জনগণকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ দিতে হবে। সংঘাত, সহিংসতায় সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব না। ক্ষমতাকে চিরস্থায়ীও করে না। রাজনীতিবিদদের মনে রাখতে হবে বর্তমান রাজনীতি নিয়ে দেশের অভ্যন্তরেই কেবল কাজ হচ্ছে না দেশের বাইরেও নানা জায়গায় নানা দল সক্রিয় আছে। আঞ্চলিক, আন্তর্জাতিক রাজনীতির সঙ্গে আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি জড়িয়ে পড়েছে। সব পক্ষের অংশগ্রহণের ভিত্তিতেই সমঝোতা হবে। একক কোনো পক্ষের হাতে এখন ক্ষমতার নাটাই নেই। ঘুড়ি, সুতা ও নাটাই নানা পক্ষ নিয়ন্ত্রণ করছে। তাই যারা সংঘাত, সহিংসতার কুটিল রাজনীতিকে ব্যবহার করে ক্ষমতাকে ধরে রাখার বা ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করবেন তারাই রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়তে পারেন। এই পরিণতি অবশ্যম্ভাবীই বলে মনে হচ্ছে এখন পর্যন্ত। আজ না হয় কাল এটা ঘটবেই। এড়ানো মুশকিল হবে।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক