বাংলাদেশে যখন নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে, তখন বাংলাদেশে ভারতের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা ফের সামনে এসেছে।
বাংলাদেশে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন এবং গণতন্ত্রের সমর্থনে গত ২৪শে মে যুক্তরাষ্ট্র নতুন ভিসা নীতি ঘোষণার পর থেকে, বাংলাদেশে এবং ভারতীয় গণমাধ্যমে জনসাধারণের বক্তব্য দুটি প্রশ্নের উপর কেন্দ্রীভূত হয়েছে: ভারত হাসিনা সরকারের প্রতি তার নিরঙ্কুশ সমর্থন অব্যাহত রাখবে কিনা এবং বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের অবস্থানের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকবে কিনা। এক্ষেত্রে, যে-ই বিজয়ী হবে, সে-ই অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপথ নির্ধারণ করতে পারে।
ভারতীয় গণমাধ্যমের অস্থির প্রতিক্রিয়া
নতুন ভিসা নীতি ঘোষণার পর থেকে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত মতামত এবং সম্পাদকীয়গুলো যুক্তরাষ্ট্রের এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে ব্যাপক অস্বস্তি প্রকাশ করে এবং এটি ভারতকে ‘কঠিন অবস্থানে’ ফেলেছে বলে স্বীকার করে নেয়। এই ভাষ্যগুলো মার্কিন পদক্ষেপকে ‘শক্তিমত্তার প্রদর্শন’ হিসেবে বর্ণনা করে এবং অভিযোগ করে যে, এটি ‘সার্বভৌম জাতির নির্বাচন এবং অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কপট হস্তক্ষেপ।’ ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের একটি বড় অংশ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এ বিষয়ে একমত বলে মনে হচ্ছে যে, হাসিনার সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার উদ্দেশ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১০ই এপ্রিল থেকে দুইবার এমন অভিযোগ করেছেন। কিছু ভারতীয় ভাষ্যকার এমনকি এই পরামর্শ দিয়েছেন যে, বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে সমর্থন করার জন্য এটি ‘সঠিক সময় নয়’। ভারতীয় ভাষ্যের সাধারণ বক্তব্য হলো- দিল্লিকে এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকবেন। একজন বিশ্লেষক লিখেছেন, ‘ভারতকে অবশ্যই আন্তর্জাতিক আইনের মধ্যে থেকে এবং বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি পরম শ্রদ্ধা রেখে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য সংসদ নির্বাচনে জয়ী হতে সহায়তা করতে হবে।’ হাসিনার প্রতি নিরঙ্কুশ সমর্থনের জন্য যে যুক্তিটি দাঁড় করানো হয়েছে তা হলো ভারতের জাতীয় স্বার্থ; একজন ভাষ্যকারের ভাষায়, “হাসিনা শাসনকে সমর্থন করা ছাড়া ভারতের আর কোনো বিকল্প নেই”, অন্যদিকে আরেকজনের ব্যাখ্যাটি এমন, ‘‘আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’ নীতিকে এগিয়ে নেয়ার চাবিকাঠি।”
উপেক্ষিত ইতিহাস
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের বর্তমান অবস্থা বুঝতে হলে আমাদের বিগত চৌদ্দ বছরে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের অগ্রগতি বিশ্লেষণ করতে হবে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে এই সম্পর্ককে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘স্বর্ণযুগ’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশি বিশ্লেষকরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে, এই সম্পর্ক সম্ভবত ভারতের পক্ষে একতরফা হয়ে গেছে। হাসিনার শাসনামলে ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিদ্রোহের মূলোৎপাটনে, বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ট্রানজিট নিতে, বঙ্গোপসাগরের দুটি প্রধান বন্দরে স্থায়ী প্রবেশাধিকার অর্জনে, একটি জ্বালানি চুক্তি স্বাক্ষর করতে (যা নিশ্চিত করে যে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ দামে বিদ্যুৎ কিনবে), বঙ্গোপসাগরে নজরদারি ব্যবস্থা ইনস্টল করতে, একটি জল-বণ্টন চুক্তি করতে (যা ভারতকে কুশিয়ারা নদীর উপর নিয়ন্ত্রণ প্রদান করে) এবং ঘনিষ্ঠ প্রতিরক্ষা সহযোগিতায় সম্পৃক্ত হতে বাংলাদেশের সমর্থন পেলেও মাত্র কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দ্বিপক্ষীয় অর্জন সাধিত হয়েছে। এর বিপরীতে, তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য বাংলাদেশের অনুরোধকে বারংবার উপেক্ষা করা হয়েছে; ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত সবচেয়ে সহিংস সীমান্তে পরিণত হয়েছে।
কারণ ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশির হত্যার মিশন চালিয়ে যাচ্ছে; দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ব্যবধান কয়েক বছর ধরে ভারতের পক্ষে বেড়েছে এবং রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে সমর্থন পায়নি। ভারতের কাছ থেকে কোনো প্রতিদান চান কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে ২০১৮ সালে হাসিনা বলেছিলেন, বাংলাদেশ যা দিয়েছে তা ভারত চিরকাল মনে রাখবে। হাসিনা সরকারের প্রতি ভারতের নিরঙ্কুশ সমর্থনের কারণে এই অসম সম্পর্ক টিকে আছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং ঢাকা সফর করেন এবং অভিযোগ রয়েছে যে, তিনি জেনারেল এইচ এম এরশাদকে নির্বাচনে অংশ নিতে চাপ দেন। সকল বিরোধী দল ওই নির্বাচন বর্জন করেছিল। ২০১৮ সালে ভারতীয় এস্টাবলিশমেন্টের কাছে এটা স্পষ্ট ছিল যে, আওয়ামী লীগ ইতিমধ্যেই ‘অত্যন্ত নিবিড়ভাবে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করেছে’ এবং সুষ্ঠু নির্বাচনে ‘আওয়ামী লীগ পরবর্তী সংসদে একটি বিব্রতকর সংখ্যালঘুতে পরিণত হবে’। তারপরও, আওয়ামী লীগকে সমর্থনে ভারত অনড় ছিল। এই ধরনের কর্মকা-ে বাংলাদেশে এমন ধারণা জন্মে যে, হাসিনা সরকারের টিকে থাকার জন্য ভারতের সমর্থন অত্যাবশ্যক। এ ধরনের সন্দেহ আরও দৃঢ় হয় যখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন (২০২২ সালে) বলেন, যেকোনো মূল্যে হাসিনা সরকারের টিকে থাকা নিশ্চিত করতে তিনি ভারতকে বলেছিলেন।
ভারতীয় মিডিয়া কাভারেজে অসংগতি
ভারতীয় ভাষ্যকারদের যুক্তিতে তিনটি অসংগতি সহজেই ধরা পড়ে:
১. বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অনুপ্রবেশ করা হচ্ছে মন্তব্য করে যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করলেও তারা সুবিধাজনকভাবে এটা উপেক্ষা করেন যে, ভারত কীভাবে গত এক দশকে তাদের প্রভাব বজায় রেখেছে। হাস্যকরভাবে সার্বভৌমত্ব নিয়ে নিজেদের উদ্বেগ জানানো বক্তব্যকে উপেক্ষা করে বর্তমান হাসিনা সরকারের পাশে থাকার জন্য তারা ভারত সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। যদিও যুক্তরাষ্ট্র বারবার নিশ্চিত করেছে যে, দেশটি কোনো দলের পক্ষে নেই বরং একটি সুষ্ঠু নির্বাচনী প্রক্রিয়ার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিচ্ছে, ভারতীয় গণমাধ্যম তাকে নির্দিষ্ট একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষে হস্তক্ষেপ করতে বলছে।
২. তারা পরোক্ষভাবে বলছেন যে, সুষ্ঠু নির্বাচনে বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) বিজয়ী হবে। এই উদ্বেগের সঙ্গে তাদের এই দাবি মেলানো কঠিন যে, বাংলাদেশ গত চৌদ্দ বছরে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাফল্য অর্জন করেছে এবং হাসিনার প্রতি বেশির ভাগ জনগণের সমর্থন রয়েছে।
৩. বিএনপি’র বিজয়ে জঙ্গিবাদ পুনরুজ্জীবিত হবে- এমন যুক্তি বিশ্বজুড়ে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর উত্থানের বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিকে উপেক্ষা করে। অগণতান্ত্রিক আচরণকে ন্যায্যতা দেয়ার জন্য ইসলামপন্থি আতঙ্ককে ব্যবহার করা থেকে এই ধরনের যুক্তি কম কিছু নয়।
যেভাবে কমান্ডিং পজিশন নিয়েছিল ভারত
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের বিশাল প্রভাব ২০০১ সাল থেকে এ অঞ্চলে একটি ভূ-রাজনৈতিক খেলার ফল এবং যুক্তরাষ্ট্রের সুস্পষ্ট অনুপস্থিতিরই প্রতিফলন। ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র (কেবল) আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানের দিকে মনোনিবেশ করেছিল। ইরাকে আগ্রাসন দক্ষিণ এশিয়া থেকে তার দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সম্পর্ক ভারতকে তার প্রভাবের ক্ষেত্র প্রসারিত করার সুযোগ দিয়েছে। এটি চীনের দৃঢ়তামূলক নীতির ফলে আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল। যা শি জিনপিং নেতা হওয়ার পর শুরু হয়েছিল, দক্ষিণ এশিয়া যুদ্ধক্ষেত্রগুলোর একটি হয়ে ওঠেছিল। যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে চীনের প্রতিষেধক হিসেবে দেখেছে। বাংলাদেশের নীতির জন্য ভারতের উপর ওয়াশিংটনের নির্ভরতা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক গতিপথে নয়াদিল্লির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে। ২০১৩-১৪ সালে নয়াদিল্লি এবং ওয়াশিংটন ঢাকায় একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কয়েক দফা আলোচনার মধ্যদিয়ে গেছে। বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা নয়াদিল্লিতে বেশ কয়েকটি সফর করেন। কিন্তু, ভারত দৃঢ় অবস্থান নেয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টাকে প্রত্যাখ্যান করে। যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে পিছিয়ে নেয়, ভারতকে তার ‘বিডিং’ করতে দেয় এবং হাসিনা সরকার ক্ষমতায় থেকে যায়। কিন্তু, বাংলাদেশে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের অব্যাহত পশ্চাদপসরণকে যুক্তরাষ্ট্র নিজের নজরের বাইরে রাখে নি। স্টেট ডিপার্টমেন্টের বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদনের মধ্যদিয়ে যা প্রতিফলিত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে ফের নজর দেয়
জো বাইডেনের প্রেসিডেন্সিতে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার ফের যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তি হয়ে উঠেছে। এতে বাংলাদেশ সংক্রান্ত নীতিতে পরিবর্তন এসেছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং এর সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা এবং ২০২২ সাল জুড়ে এবং ২০২৩ সালের প্রথম দিকের গুরুতর সতর্কতা স্পষ্টভাবে প্রকাশ করেছে যে, বাংলাদেশকে মার্কিন প্রশাসন নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। ২০১৬ সাল থেকে বাংলাদেশে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের ফোকাস বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক তাৎপর্য বাড়ায়। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বিষয়ে ‘ক্যারট অ্যান্ড স্টিক’ কৌশল গ্রহণ করেছে বলে মনে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক করোনার ভ্যাকসিন দান করেছে। কিন্তু, এই ধরনের বদান্যতার সঙ্গে গণতন্ত্রের ক্ষয় সংক্রান্ত উদ্বেগও ছিল। নয়াদিল্লির মাধ্যমে না যাওয়া এই প্রচেষ্টাগুলো এটাই দেখায় যে ‘যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে আর ভারতীয় লেন্স দিয়ে দেখছে না।’
ভারত সরকারের নীরবতা কোন বার্তা বহন করে?
গণমাধ্যমে তীব্র আলোচনা সত্ত্বেও, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নীতি কিংবা যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা সম্পর্কে নয়াদিল্লির পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য পাওয়া যায়নি। নয়াদিল্লি সচেতনভাবেই নীরব রয়েছে। ২০১৪ সালের বিপরীতে, ভারত যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ ইস্যুকে তার ‘পাবলিক পস্টার’ থেকে সরিয়ে দিচ্ছে। র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর ভারতের প্রতিক্রিয়া (দেখানোয়) নীরব ছিল, যদিও বাংলাদেশ সিদ্ধান্তটি তুলে নিতে ভারতের সাহায্য চেয়েছিল। অনেকেই ভাবছিলেন, এই পদক্ষেপ নয়াদিল্লির সঙ্গে পরামর্শ করেই নেয়া হয়েছিল কিনা। এমন কোনো ইঙ্গিত নেই যে, নয়াদিল্লি কখনো ওয়াশিংটনের কাছে বিষয়টি উত্থাপন করেছিল।
ভারতের সম্পৃক্ত না হওয়ার তিনটি ব্যাখ্যা বিবেচনাযোগ্য:
১. গণতান্ত্রিক ক্ষয় রোধের দাবিতে যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপ সত্ত্বেও নয়াদিল্লি বর্তমান অবস্থাতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে। গত দেড় বছরে, মার্কিন কর্মকর্তারা বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং গণতন্ত্র সম্পর্কে জোরালো বার্তা পাঠাচ্ছিলেন। এ সময় ভারতের পাবলিক মেসেজ ছিল হাসিনার প্রতি সমর্থন প্রদর্শন। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় খাতরা এবং এপ্রিল ও মে মাসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সফর, সেপ্টেম্বরে নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিতব্য জি-২০ সম্মেলনে পর্যবেক্ষক হিসেবে হাসিনাকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণ জানানো উল্লেখযোগ্য সব ঘটনা। এগুলো এই ধারণাই দেয় যে ‘নয়াদিল্লি… যেকোনো উপায়ে হাসিনার জয় চায়।’ আগামী মাসগুলোতে বাইডেন প্রশাসনের বাংলাদেশ নীতিকে নরম করার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে রাজি করাতে ভারত তার নিজের সুবিধাকে ব্যবহার করবে কিনা সেটি দেখার বিষয়।
২. ভারত বাংলাদেশের ওপর মার্কিন চাপের বিরোধিতা করছে না। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কথোপকথন এবং চীনের প্রতিপক্ষ শক্তি হিসেবে কাজ করার জন্য এই চাপ হাসিনাকে দুর্বল এবং ভারতের ওপর আরও নির্ভরশীল করে তুলবে। ঢাকার শাসন ব্যবস্থা যত বেশি দুর্বল হবে, নয়াদিল্লি তত বেশি সুবিধা পাবে।
৩. এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে উচ্চ-ঝুঁকির ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং এই টানাপড়েনে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব বিবেচনায় ভারত ক্ষুব্ধভাবে এটা স্বীকার করছে যে, সে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি গৌণ বহিরাগত এক্টর হয়ে উঠছে। যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে আর শক্তিশালী খেলোয়াড় বলে মনে করে না।
যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের কী করা উচিত?
ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক জটিল। উভয় দেশই কৌশলগত পারস্পরিক নির্ভরতার ওপর জোর দেয়। যা কোয়াড ও ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল এবং প্রতিরক্ষা ও বাণিজ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পৃক্ততার মতো বহুপক্ষীয় কাঠামোর মাধ্যমে তাদের ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা প্রতিফলিত হয়। যদিও, ভারতের নিজস্ব গণতান্ত্রিক অবক্ষয় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। উপরন্তু, কেউ কেউ ভারতের বিদেশ নীতির ওপর নির্ভরযোগ্যতা এবং চীনের বিরুদ্ধে (যুক্তরাষ্ট্রের জন্য) ভারত নিরাপদ বাজি কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন।
আগামী সপ্তাহে ওয়াশিংটনে বাইডেন- মোদি শীর্ষ বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে বাংলাদেশ ইস্যুটি অন্তর্ভুক্ত করা হবে কিনা তা জানা যায় নি। বিশ্বের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে ভিন্নতার অন্যান্য কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় বাংলাদেশকে কম তাৎপর্যপূর্ণ মনে হতে পারে। তবে, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের সঙ্গে সম্পর্কিত বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক বিবেচনাগুলো নিঃসন্দেহে এই বার্তা দেয় যে, বাংলাদেশ মনোযোগ পেতে পারে। ভারতকে এটা জানানো যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্ব যে তারা বাংলাদেশের গণতন্ত্র রক্ষার প্রতিশ্রুতি অনুসরণ করবে এবং তার বৃহত্তর দক্ষিণ এশিয়া নীতি নয়াদিল্লির সঙ্গে নিজের সম্পর্কের দ্বারা রূপান্তরিত হবে না। এখন এটাই দেখার বিষয় যে, ভারত কীভাবে তার বৈশ্বিক আকাঙ্ক্ষা এবং আঞ্চলিক পছন্দের মধ্যেকার টানাপোড়েন সামলায়।
[যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট আলী রীয়াজের লেখাটি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিংক ট্যাংক আটলান্টিক কাউন্সিলের ওয়েবসাইটে ১৫ই জুন ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়েছে। অনুবাদ করেছেন তারিক চয়ন]