‘সামনের নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে আরো বড় বিপদ ঘটবে: বদিউল আলম

বদিউল আলম মজুমদার। অর্থনীতিবিদ, উন্নয়নকর্মী, রাজনীতি বিশ্লেষক, স্থানীয় সরকার ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক দাতব্য সংস্থা ‘দি হাঙ্গার প্রজেক্ট’র বাংলাদেশি শাখার পরিচালক ও বৈশ্বিক সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। একই সঙ্গে তিনি নাগরিক সংগঠন ‘সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক’র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

রাজনীতি ও আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজের। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে শেষটি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।

জাগো নিউজ: আগের পর্বে ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন প্রক্রিয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু সবার মতামতের ভিত্তিতেই নির্বাচন কমিশন গঠন হলো এবং এই সরকার নির্বাচনী আইন করলো।

বদিউল আলম মজুমদার: নির্বাচন প্রক্রিয়ায় ত্রুটি থাকলেও সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব। কিন্তু গুরুতর সমস্যা হচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো চরম মাত্রায় দলীয়করণ হয়ে গেছে। প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও নির্বাচন কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা ভয়াবহভাবে কমে গেছে। বড় সংকট হচ্ছে নির্বাচনী মাঠ অসমতল হয়ে গেছে। দলীয় সরকারের কারণে নির্বাচন হওয়ার কারণেই এমন পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে।

জাগো নিউজ: সামনের ফলাফল কী?

আরও পড়ুন>> ‘নির্দলীয় সরকার ছিল বলেই চারটি নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছিল’

বদিউল আলম মজুমদার: ভোট ব্যবস্থা ভেঙে পড়লে সর্বস্তরে দায়বদ্ধতা আর থাকে না। ফলাফল এটিই। মানুষ চরম কষ্টে আছে। কিন্তু মাঠে নামছে না। কোনো জবাবদিহিতাও নেই। বৈষম্য বাড়ছে, মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে। অথচ সরকার এসব বিবেচনা করে কোনো সিদ্ধান্ত নেয় না। মানে দায়বদ্ধতা কাজ করে না। যেনতেনভাবে আরেক নির্বাচন করে ক্ষমতায় আসতে চায়। ভোটের জন্য জনগণের কাছে যেতে হয় না বলেই এই অরাজকতা।

পাঁচবছর পরপর প্রার্থীরা ভোটারদের কাছে ভোট ভিক্ষা করার কথা এবং ভোটাররা লাল কার্ড দেখানোর সুযোগ পায়। ভোটাররা তাদের অধিকার নিয়ে দরকষাকষি করতে পারে। এখন তা পারে না। সরকারের ভোট ঠিক করে দিচ্ছে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

জাগো নিউজ: সরকার তো নির্বাচনী অপরাধের দায়ে সাজার ব্যবস্থা রেখেছে, আইন করেছে।

বদিউল আলম মজুমদার: নির্বাচনী অপরাধের দায়ে এক থেকে সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ড হওয়ার কথা। অথচ অপরাধের মধ্য দিয়েই সরকারকে ক্ষমতায় এনেছে এবং একটি সাজার ঘটনাও দেখাতে পারেনি। আইনসভার মাধ্যমে নির্বাহী বিভাগ যেভাবে দায়বদ্ধতা দেখানোর কথা, তা দেখায় না। সব কাঠামো ভেঙে গেছে। মানুষ ভোট দিতে না পারার কারণেই সব ভেঙে গেছে।

জাগো নিউজ: আঁধার কাটবে না?

বদিউল আলম মজুমদার: আমরা যদি একটি সুষ্ঠু নির্বাচন, জনগণের সম্মতির ভিত্তিতে শাসনব্যবস্থা কায়েম করতে না পারি তাহলে আঁধার আরও ঘনীভূত হবে। সামনের নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে ভয়ানক বিপদ ঘটবে।

জাগো নিউজ: যেমন?

আরও পড়ুন>> ‘সাধারণ মানুষের জন্য সাধারণ মানুষকেই জাগতে হবে’

বদিউল আলম মজুমদার: দিন যাচ্ছে সংকট বাড়ছে। এই সংকট আওয়ামী লীগের জন্যও। সরকার কিন্তু ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের মতো নির্বিঘ্নে একতরফা নির্বাচন করতে পারছে না।

জাগো নিউজ: কেন এমন মনে করছেন?

বদিউল আলম মজুমদার: দেশের ভেতর ও বাইরে থেকে প্রচণ্ড চাপ তৈরি হয়েছে। বিরোধী জোটও মাঠে নামছে।

জাগো নিউজ: বিরোধী জোট আগেও মাঠে নেমেছিল?

বদিউল আলম মজুমদার: এখন চাপ চরমে। মূল্যস্ফীতি, বিদ্যুৎ না থাকা, জ্বালানি সংকট মানুষকে অনিশ্চয়তায় ফেলে দিচ্ছে। দুর্নীতি, লুটপাট, ভুল প্রকল্প সরকারের ওপর চাপ আরও বাড়িয়েছে। বৈশ্বিক চাপ যুক্ত হয়েছে এখানে।

জাগো নিউজ: ২০১৪ সালে বিরোধী জোটের চাপ আরও বেশি ছিল। সরকার আমলে নেয়নি?

বদিউল আলম মজুমদার: প্রেক্ষাপট বদলে যাচ্ছে। তখন সরকার প্রশাসনের অকুণ্ঠ সমর্থন পেয়েছে।

জাগো নিউজ: এখন তো এই সমর্থন আরও বাড়ার কথা?

বদিউল আলম মজুমদার: আমার তা মনে হয় না। বৈশ্বিক চাপের কারণে অনেকের বোধদয় হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো কোনো সদস্যকে। অনেকের জন্য এটি ভয়ঙ্কর বার্তা বলে মনে করি।

জাগো নিউজ: আপনি ভয়ঙ্কর বলছেন। সরকারপ্রধান তো আটলান্টিকের ওপারে যাওয়ার ব্যাপারে অনাগ্রহ দেখাচ্ছেন।

বদিউল আলম মজুমদার: সরকারপ্রধানের কথায়ই ভয়াবহ বার্তা মিলছে। নইলে এভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করতে পারেন না। মুখে অনেক কথাই বলা যায়। ভেতরের বিষয় আলাদা।

অনেকেই অনিচ্ছাকৃতভাবে নির্বাচনী অপরাধের সঙ্গে জড়িয়েছিল। তারা এমন অপরাধ করে সরকারকে টিকিয়ে রাখতে চাইবে না।

জাগো নিউজ: প্রশাসনের কেউ কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি?

বদিউল আলম মজুমদার: গাজীপুরের নির্বাচনে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা লক্ষ্য করার মতো ছিল। বিরোধীদলের কেউ বাড়িতে থাকতে পারেনি। এখন কিন্তু বাড়িতে থাকতে শুরু করেছে।

জাগো নিউজ: নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা ক্রমাগতভাবে সরকারের, নির্বাচন ব্যবস্থার সমালোচনা করছেন। মার্কিন ভিসানীতির জন্য নাগরিক সমাজও দায়ী বলে সরকারপক্ষ মনে করছে।

আরও পড়ুন>> শেখ হাসিনা বোল্ড লেডি, তিনি ভয় পান

বদিউল আলম মজুমদার: যারা এ অভিযোগ করেন, তারা নাগরিক সমাজের ভূমিকা সম্পর্কে কোনো ধারণা রাখেন না। নাগরিক সমাজের কাজ হচ্ছে সরকারের অন্যায়ের সমালোচনা করা। নাগরিক সমাজ নাগরিকের হয়ে অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মানুষকে সচেতন করে তোলাই নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের কাজ।

জাগো নিউজ: এই সচেতন করার নামে সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্রের অভিযোগও আছে।

বদিউল আলম মজুমদার: সরকারের সমালোচনা করা, নাগরিককে সচেতন করে তোলা আইনবিরোধী কোনো কাজ নয়। প্রত্যেক নাগরিকের এ অধিকার আছে। সরকার চাইলে ষড়যন্ত্রকারীদের বিচার করতে পারে, সাজা দিতে পারে। তা তো করে না।

জাগো নিউজ: আপনাদের সমালোচনা বিশ্বমহলকে নাক গলাতে সুযোগ করে দিচ্ছে?

বদিউল আলম মজুমদার: এদেশ আমাদের সবার। আমাদের বন্ধুরা মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ দিয়েছে। এদেশকে মানুষের জন্য বাসযোগ্য করে তোলা সবার দায়িত্ব। কেউ যদি এখানে ষড়যন্ত্র খোঁজে, এটি তাদের সমস্যা। আমরা দায়িত্ব পালন করছি।

জাগো নিউজ: যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের বিপরীতেও দায়িত্ব পালন করার কথা। নতুন ভিসানীতি আমাদের জন্য অপমানের অবশ্যই?

বদিউল আলম মজুমদার: অবশ্যই নাগরিক হিসেবে আমার জন্য চরম অবমাননাকর। আমি লজ্জিত। কিন্তু এর দায় কার? সরকার লজ্জিত কি না সেটা দেখার বিষয়। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি মহাবিপদের ঘণ্টাধনী। আমরা সংশোধন হয়ে গেলে তো আর ভয়ের কারণ নেই।

জাগো নিউজ: আপনি কি মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের এই ভিসানীতি সামনের নির্বাচনে অপরাধ কমাতে সহায়তা করবে?

বদিউল আলম মজুমদার: আমি সঠিক বলতে পারছি না। তবে আমাদের নিজেদের স্বার্থেই অপরাধের পথ পরিহার করা উচিত। জনগণের ক্ষমতায়নে নিরপেক্ষ ভোট ব্যবস্থা জারি করা জরুরি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *