ইসলামী ব্যাংক থেকে একটি বেনামী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ৩০০ কোটি টাকা তুলে নিতে যাচ্ছিল দেশের আর্থিক খাতের মাফিয়া ডন নামে খ্যাত এক সময়ের সাইফুল আলম মাসুদ ওরফে এস আলমের পিএস আকিজ উদ্দিন। কিন্তু এই আকিজ উদ্দিনের সুবিধাভোগী প্রতিষ্ঠানের চেক বুঝতে পেরে গতকাল তা ফেরত পাঠিয়েছে ইসলামী ব্যাংক। চেকগুলো সোনালী, জনতা ও রূপালী ব্যাংকের মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখা থেকে উত্তোলন করার কথা ছিল।
এ দিকে একজন পিএস হয়ে দেশের সর্ববৃহৎ আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইসলামী ব্যাংকের ডিএমডি বনে যাওয়া এ আকিজ উদ্দিন এখন কোথায় তা খোদ ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তারাও জানেন না। ইসলামী ব্যাংকের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টিকারী আকিজ উদ্দিন গতকাল ব্যাংকে আসেননি। আবার ব্যাংক থেকে তিনি ছুটিও নিয়ে যাননি। তাহলে আকিজ উদ্দিন গেল কোথায়। কেউ বলছেন ব্যাংক থেকে নানা কায়দায় শত শত কোটি টাকা বের করে নিয়ে যাওয়া অত্যন্ত ধূর্ত এ আকিজ উদ্দিন বাতাস ঘুরে যেতে পারে- এটা আগেই বুঝতে পেরেছিলেন। আর এ কারণে তিনি দেশ থেকে পালিয়ে তুরস্কে পাড়ি জমিয়েছেন। আবার কেউ বলছেন তিনি দেশেই কোথাও আত্মগোপনে আছেন।
তবে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, তিনি দেশে থাকলে তাকে দ্রুত আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন। দেশ থেকে তিনি যেন কোনোভাবে পালিয়ে যেতে না পারে সে বিষয়ে সজাগ থাকার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অনুরোধ করেছেন। কেননা, দেশের আর্থিক খাত দুর্বল করার জন্য এসআলমের পরে যদি কেউ দায়ী থাকেন আর তিনি হলেন এ ধূর্ত আকিজ উদ্দিন। তিনি কিভাবে নামে বেনামে কোম্পানি খুলে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করা যায় তার মাস্টার মাইন হিসেবে কাজ করতেন। তার কথা পরিপালন না করলে কথায় কথায় ইসলামী ব্যাংকের মেধাবী কর্মকর্তাদের চাকরি খেতেন। কখনো মানসিক চাপ দিয়ে চাকরি থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য করাতেন।
ইসলামী ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সাধারণত একটি নির্ধারিত পরিমাণ অর্থের চেক শাখা ব্যবস্থাপকই নগদায়ন করে দিতে পারেন। কিন্তু বেশি অঙ্কের চেক নগদায়নের জন্য ব্যাংকের হেড অফিসের অনুমোদন নিতে হয়। গতকাল ইসলামী ব্যাংকের চট্টগ্রাম আগ্রাবাদ শাখায় সোনালী, জনতা ও রূপালী ব্যাংকের ৫টি চেক নগদায়নের জন্য পাঠানো হয়। গ্লোডেন স্টার নামক একটি প্রতিষ্ঠান এ ৫টি চেক ইস্যু করেছিল। প্রতিষ্ঠানের মূল অ্যাকাউন্ট ছিল আগ্রবাদ শাখায়।
জানা গেছে, গ্লোডেন স্টার নামক প্রতিষ্ঠানটি মূলত আকিজ উদ্দিন ও এসআলম গ্রুপের সুবিধাভোগী বেনামী প্রতিষ্ঠান। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ওই অ্যাকাউন্ট থেকে বিভিন্ন ব্যক্তিকে ঘুষ দেয়ার কথা বলে মাঝে মধ্যে বড় অঙ্কের টাকা উত্তোলন করা হতো। জানা গেছে, আলোচিত ৫টি চেক আগ্রাবাদ শাখা ম্যানেজার প্রাথমিক অনুমোদন দেয়ার পর চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য ইসলামী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হয়। কিন্তু এসব চেক আকিজ উদ্দিন ও এসআলম গ্রুপের বেনামী চেক বুঝতে পেরে তা আটকে দেয়া হয়। এভাবেই ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সচেতনতার মাধ্যমে তিনশ’ কোটি টাকা আটকে দেয়া হয়।
এ দিকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশেষ করে আমদানি রফতানির মাধ্যমে এসআলমের কোটি কোটি টাকা পাচারের সহযোগিতা করেছিলেন ইসলামী ব্যাংকের আরেক ডিএমডি মিফতা উদ্দিন। তার ভয়ে তটস্ত থাকত অধীনস্তরা। অবৈধভাবে অর্থ পাচারের কাজে যারাই বাধা হতো তাদেরকেই রাজাকার বা জামায়াতশিবিরের তকমা নিয়ে চাকরিচ্যুত করা হতো। গতকাল ব্যাংক খুললেও মেফতা উদ্দিন অফিসে আসেননি। সবাই প্রশ্ন করছেন এই মিফতা উদ্দিন এখন কোথায়।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ইসলামী ব্যাংকের বিদেশী শেয়ার বিক্রি ও এসআলমের বেনামী প্রতিষ্ঠানের নামে কেনার কাজে সহযোগিতা করতেন জেকিউএম হাবিবুল্লাহ। তিনি ইসলামী ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও কোম্পানি সেক্রেটারি। বেনামী ঋণ সৃষ্টি করে ওই অর্থ দিয়েই ইসলামী ব্যাংকের বিদেশী কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে এসআলমের বেনামী প্রতিষ্ঠানের নামে শেয়ার কিনতে সহযোগিতা করেছেন এই হাবিবুল্লাহ। আর এর মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। গতকাল ওই হাবিবুল্লাহও অফিসে আসেননি। তিনিও কোথায় তা কেউ জানেন না। আবার অফিস থেকে ছুটিও নেননি।
এদিকে, দেশের সবচেয়ে বড় বেসরকারি ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক থেকে এস আলম গ্রুপের প্রভাবমুক্তির জন্য কঠোর অবস্থান দিয়েছে ব্যাংকটির সর্বস্তরের কর্মকর্তারা। দীর্ঘদিন পদবঞ্চিত, অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত ও হয়রানির শিকার কর্মকর্তা কর্মচারীরা গতকাল ইসলামী ব্যাংকের সামনে অবস্থান করেন। তারা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে, ২০১৭ সালের পরে যত নির্বাহী এসেছেন, তারা আর ব্যাংকে ঢুকতে পারবেন না।
এ বিষয়ে ব্যাংকের সিবিএ নেতা আনিসুর রহমান জানিয়েছেন, ২০১৭ সালের পরে যত নির্বাহী এসেছেন, তারা আর ব্যাংকে ঢুকতে পারবেন না। বিক্ষুব্ধ কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে তিনি আরো বলেন, ‘আপনারা শান্ত হোন। যে ইসলামী ব্যাংক দখল হয়েছে, তা আবার ফিরে আসবে। এমডি (ব্যবস্থাপনা পরিচালক) মহোদয় আমাকে প্রতিনিধি হিসেবে পাঠিয়েছেন।’ তিনি বলেন, ২০১৭ সালের পর থেকে পরীক্ষা ছাড়া অনিয়মের মাধ্যমে যেসব নিয়োগ হয়েছে, সেসব নিয়োগ বাতিল করা হবে। একই সাথে ওই সময়ের পরে যাদের চাকরি অবৈধভাবে বাতিল করা হয়েছে, তাদের চাকরি পুনরায় ফিরিয়ে দেয়া হবে। এ ছাড়া গত সাত বছরে যারা পদোন্নতি বঞ্চিত হয়েছেন, তাদের যথাযথভাবে পদোন্নতি দেয়া হবে।
প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালে এস আলম গ্রুপ সরকারের একটি এজেন্সিকে ব্যবহার করে ইসলামী ব্যাংককে দখল করে নেয়। এরপর গত সাত বছরে ব্যাংকটির অনেক কর্মকর্তাকে জোরপূর্বক চাকরি ছাড়তে বাধ্য করা হয়। অন্য দিকে বিধিবিধানের তোয়াক্কা না করে গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন অন্য ব্যাংক থেকে বেশ কিছু কর্মকর্তাকে এনে ইসলামী ব্যাংকের উচ্চ পদে বসানো হয়। আর এসব কর্মকর্তার যোগসাজশে ব্যাংকটি থেকে বেনামী ঋণের মাধ্যমে সরিয়ে নেয়া হয় কোটি কোটি টাকা। এস আলম গ্রুপের লাগামহীন লুটপাটে একসময়ের সবচেয়ে ভালো মানের ইসলামী ব্যাংক রুগ্ণ হয়ে পড়ে। দেখা দেয় তীব্র তারল্য সঙ্কট। ব্যাংকটিকে টিকিয়ে রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে তারল্য জোগান দেয়।